Ultimate magazine theme for WordPress.

সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহে ব্যস্ত মৌচাষীরা

রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে

0

কৃষিখবর প্রতিবেদক : ষড়ঋতুর বাংলাদেশে চলছে শীতকাল। এই মৌসুমে সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন মৌচাষীরা। সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌবাক্স স্থাপন করে কৃত্রিম পদ্ধতিতে ভ্রাম্যমাণ মধু সংগ্রহ করছেন তারা। এর মাধ্যমে অনেকের বেকারত্বও দূর হয়েছে। বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে সরিষা ফুলের মধু।

বর্তমানে সরিষা ফুলের মধু সর্বোত্তম মধু হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। মৌমাছিরা সরিষার ফুল থেকে যে মধু সংগ্রহ করে মৌচাক বানায় সেখানেই মেলে উন্নত মানের মধু। খুলনার সুন্দরবনে মৌচাকের বাওয়ালিরা সরিষা ফুলের মধুর মৌচাক খুঁজে বেড়ায়। দেশের প্রতিটি স্থানে সরিষার মৌসুমে কাঠের বিশেষ ধরনের বাক্সে মৌমাছি পালন করে ক্ষেতে রাখা হয়। মৌমাছিরা সরিষার ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে ক্ষেতের মধ্যে পেতে রাখা বাক্সগুলোতে বাসা বানায়। এই বাক্সে চাক বানায়। মৌচাক পূর্ণ হয়ে মধুতে ভরে গেলে মধু বের করে নেয়া হয়। বর্তমানে সরিষা ফুলের মধু দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশেও পৌঁছেছে। ফলে মধু এখন কৃষকের আয়ের বড় পথ হিসেবে জাতীয় রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক গ্রামে সরিষা মৌসুমে প্রশিক্ষিত মৌ পালনকারীরা ফসল ঘরে তোলার মতো বাক্স থেকে মধু সংগ্রহ করে।

নওগাঁর মান্দা উপজেলার বেকার শিক্ষিত যুবকরা বাণিজ্যিকভাবে সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহে নেমেছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, এ বছর জেলায় ২৭ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ করা হয়েছে। মান্দা ও সাপাহার উপজেলায় প্রায় ২ হাজার ২০০টি মৌবাক্স স্থাপন করা হয়েছে। এ বছর জেলায় ২৫ হাজার কেজি মধু আহরণের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে।
মান্দা উপজেলার ভারশো, বাঁকাপুর, কৈইকুড়িসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের ফসলের মাঠে সরিষা ফুল থেকে কৃত্রিম পদ্ধতিতে মধু সংগ্রহ করছেন মৌচাষীরা। তবে স্থানীয়ভাবে মধু সংগ্রহ না হলেও রাজশাহী জেলার মোহনপুর উপজেলার দর্শনপাড়া থেকে এসে মধু সংগ্রহ করছেন দুই মৌচাষী। সরিষা ক্ষেত এলাকায় অভিনব পন্থায় ইউরোপিয়ান মেলিফেরা জাতের মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত দেখা যায় তাদের। ক্ষেতের পাশে ৬০টি মধুবাক্স স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি বক্সে ৮টি করে ফ্রেম সাজানো আছে। সপ্তাহ পর পর ফ্রেম থেকে সংগ্রহ করা হয় মধু।

উপজেলার কৈইকুড়ি গ্রামের মৌচাষী আরিফ হাসান ২০১৩ সালে মৌচাষের ওপর বিসিক থেকে এক মাসের প্রশিক্ষণ নেন। এরপর ৭০০ টাকা করে ৩৫টি ফ্রেম কিনে আনুষঙ্গিক প্রায় ৩৫ হাজার টাকা খরচ করে মৌচাষ শুরু করেন। খামারের নাম দিয়েছেন ‘বরেন্দ্র মৌখামার’। ২০১৬ সালে কয়েকটি জেলায় প্রায় ৫২ মণ মধু সংগ্রহ করে প্রায় ৪ লাখ টাকার মতো বিক্রি করেছিলেন। আর খরচ হয়েছিল প্রায় ৮০-৯০ হাজার টাকা। এছাড়া মৌমাছি বিক্রি করেছিলেন ৭০-৮০ হাজার টাকা। এ বছর প্রায় ৫ লাখ টাকার মতো মধু বিক্রি করবেন বলে জানান তিনি। মৌচাষী রুস্তম আলী বলেন, রাজশাহী, দিনাজপুর, পাবনা, নাটোর ও নওগাঁ জেলায় প্রায় ৭ মাস মধু সংগ্রহ করেন। বাকি সময় মৌমাছিকে রয়েল জেলি খাওয়াইয়ে পুষতে হয়।

নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সরিষা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ হয়। মূলত সরিষা, কালাই জিরা ও লিচু ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করেন। সরিষা ও লিচুর মধু পাইকারি ২৫০ টাকা ও খুরচা ৩০০ টাকা কেজি এবং কালাই জিরা মধু পাইকারি ৪০০ টাকা ও খুরচা ৫০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করেন। বেঙ্গল কোম্পানিসহ বিভিন্ন প্রসাধনী তৈরি কোম্পানির কাছে পাইকারি করেন। আমাদের মতো ক্ষুদ্র যারা খামারি আছেন তাদের উন্নত প্রশিক্ষণ এবং স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হলে আগামী বাণিজ্যিকভাবে মধু সংগ্রহ সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের কাশিমপুর গ্রামের বিস্তৃত ফসলের মাঠ জুড়ে হলুদের রাজ্য দেখে মনে হয়েছে ফসলের মাঠে যেন আগুন লেগেছে, সেই আগুনের সৌন্দর্য্য আকৃষ্ট করছে প্রকৃতি প্রেমিদের। সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আমন ধানের পরে সরিষা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন ফেনীর তারা। কম খরচে লাভ বেশি হওয়ায় সরিষা চাষে আগ্রহ বাড়ছে দিন দিন।

জামালপুরের সাতটি উপজেলার মাঠে মাঠে এখন নয়নাভিরাম সরিষার হলুদ ফুলের অপরূপ দৃশ্য। পুরো মাঠ যেন ঢেকে আছে অপার সুন্দর এক হলুদ গালিচায়। সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহে এসব জমির পাশে পোষা মৌমাছির শত শত বাক্স নিয়ে হাজির হয়েছেন মৌয়ালরা। ওইসব বাক্স থেকে হাজার হাজার মৌমাছি উড়ে গিয়ে মধু সংগ্রহে ঘুরে বেড়াচ্ছে সরিষা ফুলের মাঠে।

ইসলামপুর উপজেলার চরপুটিমারী, গাইবান্ধা, চরগোয়ালিনী, গোয়ালেরচর ও পলবান্ধা ইউনিয়নের বেশিরভাগ ফসলি জমিতে সরিষার আবাদ করা হয়েছে। এসব জমিতে সরিষার ফুল ফুটতে শুরু করেছে। এসব ফুলের মধু আহরণে নেমেছেন পেশাদার মৌয়ালরা। তাদের বাক্স থেকে দলে দলে উড়ে যাচ্ছে পোষা মৌমাছি। ঘুরে বেড়াচ্ছে এ ফুল থেকে ও ফুলে। আর সংগ্রহ করছে মধু। মুখভর্তি মধু সংগ্রহ করে মৌমাছিরা ফিরে যাচ্ছে মৌয়ালদের বাক্সে রাখা মৌচাকে। সেখানে সংগৃহীত মধু জমা করে আবার ফিরে যাচ্চে সরিষার জমিতে।

ইসলামপুরের চরপুটিমারী ইউনিয়নের চিনারচর গ্রামে পোষা মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহে আসা সাতক্ষীরার পেশাদার মৌয়াল আমিরুল ইসলাম জানান, তিনি প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও পোষা মৌমাছির ১৫০টি বাক্স নিয়ে সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহে ইসলামপুরে এসেছেন। তিনি এ বছর প্রতি সপ্তাহে গড়ে আট মণ মধু সংগ্রহ করতে পারছেন। একই উপজেলার চরপুটিমারী ইউনিয়নের চিনারচরচর এলাকায় সরিষার ফুলের মধু সংগ্রহে আসা সাতক্ষীরার পেশাদার মৌয়াল মো. ইস্রাফিল হোসেন জানান, তিনি পনের দিন ধরে পোষা মৌমাছির ১২০টি বাক্স নিয়ে সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহ করছেন। এখানে সরিষার ফুল থেকে মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহ করে তিনি যেমন লাভবান হচ্ছেন ঠিক তেমনি মৌমাছির ব্যাপক পরাগায়নে সরিষার বাম্পার ফলন হওয়ার সম্ভাবনায় স্থানীয় চাষিরাও খুশি হচ্ছেন।

এসব মৌয়ালদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর সাতক্ষীরা ও মধুপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শতাধিক পেশাদার মৌয়াল জামালপুরের সাতটি উপজেলায় সরিষা ফুল থেকে মধু সংগ্রহের কাজ করছেন। এসব মধু বিক্রি করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন মৌয়ালরা এবং মধ্যস্বত্তভোগীরা মধু বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করছেন।

জামালপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জামালপুরের সাতটি উপজেলায় এ বছর রবি মৌসুমে সাত হাজার ৩৮৫ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ করা হয়েছে। আর উৎপাদন হতে পারে আট হাজার ৭০০ মেট্রিকটন সরিষা। রোপা আমন কেটে বোরো ধান রোপণের আগে একটি বাড়তি অর্থকরি ফসল হিসেবে সরিষার আবাদ করে কৃষকরা বেশ লাভবান হচ্ছেন। আবার ওইসব সরিষার ফুল থেকে পোষা মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহে লাভবান হচ্ছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পেশাদার মৌয়ালরা।

রাজশাহীর তানোরে ব্যাপকভাবে রোপণ করা হয়েছে সরিষা। প্রতিটি গাছে হলুদ ফুলে ভোরে গেছে। সেই হলুদ ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করার জন্য পাশের উপজেলা মোহনপুর কেশর হাট থেকে সততা নামের মৌ খামার এসেছে মধু সংগ্রহ করতে। সততা মৌ খামারের তিনজন খামারি গত ৫ জানুয়ারি থেকে মধু সংগ্রহ শুরু করেছেন। চারদিকে শুধু সরিষার হলুদ ফুল আর ফুল। ফুলে বসানো হয়েছে মৌমাছি। চারদিকে শুধু মৌ মৌ ডাক। সরিষার খেতে এক হাত পর পর দেওয়া কাঠের রঙের বক্স। বক্সের ভিতরে আছে ফ্রেম। সেই ফ্রেমে থাকে মৌমাছি। একটি করে ফ্রেমে অন্তত ১ হাজারটি মৌমাছি থাকে। ফ্রেম থেকে মৌমাছি বের করে মধু ভর্তি ফ্রেম দেওয়া হচ্ছে রিফেন্ড মেশিন। দুই থেকে তিনটি করে ফ্রেম ঢুকানো হচ্ছে মেশিনে। হাত দিয়ে ঘুরিয়ে মেশিনের নিচে পাইপ দিয়ে চলে আসছে মধু। তিনজন এ কাজের সাথে সংযুক্ত।

তার নিকটাত্মীয় সততা মৌ খামারের পরিচালক আলফোর জানান, ২০১২ সাল থেকে এভাবে মধু সংগ্রহ করে আসছি। প্রথম অবস্থায় মাত্র ১০ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করে বর্তমানে তার পুঁজি প্রায় ২ লাখ টাকা। সে সাফ জানিয়ে দেয়, চাকরি করার কোন ইচ্ছে নেই।
//এআরএইচ//

Leave A Reply

Your email address will not be published.