Ultimate magazine theme for WordPress.

‘ডার্ক নাইট–গেস্টরুম’ আতঙ্কে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা

0

কৃষিখবর ডেস্ক : বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীটির সে রাতে ঘুম ভেঙেছিল দরজা-জানালায় লাথির শব্দে। দরজা খুলতেই ‘ভাইয়েরা’ দ্রুত তৈরি হয়ে গেস্টরুমে (অতিথিকক্ষ) চলে যেতে বলেন। তাঁদের বলা হয়, ‘ডার্ক নাইট’ উদযাপন করা হবে। রাতটা ভালোয় ভালোয় পার করতে পারলে হলে একটা আসন পাওয়া যেতেও পারে। খবর প্রথম আলো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের ওই শিক্ষার্থী থাকেন ফজলুল হক হলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ‘ডার্ক নাইট’ ও ‘গেস্টরুম কালচার’ নিয়ে সম্পর্কে তিনিসহ পাঁচটি ছাত্র হলের শিক্ষার্থীরা জানান, বলেন, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রথম সেমিস্টারে আবাসিক হলভেদে মাস ছয়েক এই নির্যাতন চলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নেতৃত্বে। ডার্ক নাইট বা গেস্টরুম কালচার আসলে কেমন? ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের কাছে এটা হলের নতুন ছেলেদের সঙ্গে পরিচিতি পর্ব। অবশ্য প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা বলছেন অন্য কথা।

ফজলুল হক হলের ওই শিক্ষার্থী বলেন, এ বছরের ৪ অথবা ৫ জানুয়ারির রাতের ঘটনা। ডার্ক নাইটের আগ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। হলে ঢোকার পরপরই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের গণরুম বা অন্য কোনো কক্ষে তুলে দেন। সন্ধ্যায় হল কর্তৃপক্ষের আয়োজনে ‘ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম (পরিচিতি পর্ব)’, ভালো খাওয়া-দাওয়া, ছাত্রলীগসহ বামপন্থী কিছু ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের বক্তৃতা-বিবৃতি চলে। অনুষ্ঠান শেষে ছাত্রলীগের ‘ভাইয়েরা’ কক্ষে পাঠিয়ে দেন ঘুমানোর জন্য। সব বদলে যেতে শুরু করে রাত ১২টা নাগাদ।

ওই শিক্ষার্থী সেই রাতের অভিজ্ঞতার বিষয়ে বলেন, ‘ভাইয়েরা বলল, এক মিনিটের মধ্যে জামা-কাপড় বদলে নিচে নামো। ফুলহাতা শার্ট, প্যান্ট, ভালো জুতা পরে আমরা বি ব্লক থেকে সি ব্লকের দিকে দৌড়াতে শুরু করলাম। ব্লকের মোড়ে মোড়ে ভাইয়েরা দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় বলে দিচ্ছিল কোন দিক থেকে কোথায় যেতে হবে।

‘গেস্টরুম’ বা অতিথিকক্ষে ঢুকে দেখেন, বাতি জ্বলছে-নিভছে। সেখানে প্রথম বর্ষের ৫০-৬০ জন শিক্ষার্থী ছিলেন। ভাইদের কারও হাতে তখন ক্রিকেট খেলার স্টাম্প, কারও হাতে চাপাতি। ঢোকার পরপরই ‘ভাইয়েরা’ গানের সঙ্গে নাচতে বলেন। যাঁরা ইতস্তত করছিলেন, তাঁদের ‘মুরগি’ (উবু হয়ে বসে হাঁটুর নিচ থেকে হাত নিয়ে কান ধরা) বা চেয়ারের মতো করে (হাঁটু ভেঙে হাত সামনে দিয়ে) থাকতে বলা হয় পরবর্তী তিন ঘণ্টার জন্য। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই এই নির্দেশ লম্বা সময় পালন করতে পারেননি। তাঁদের প্রথম রাতেই চড়-থাপ্পড় কিংবা স্টাম্পের বাড়ি খেতে হয়।

সে রাতেই হলে কী করা যাবে কী করা যাবে না, তার একটি ফর্দ ধরিয়ে দেওয়া হয়। জানিয়ে দেওয়া হয় প্রতি রাতেই গেস্টরুমে ডাক পড়বে। ডার্ক নাইট শেষে প্রথম বর্ষের সব শিক্ষার্থীকে একটি করে কলা খেতে দিয়ে ভাইয়েরা বলেন, ‘এটা কিছুই না, জাস্ট পরিচিতি পর্ব।’ ওই শিক্ষার্থী যখন কক্ষে ফেরেন, তখন ভোরের আজান দিচ্ছে। এরপর টানা ছয় মাস সভা-মিছিলের পাশাপাশি ‘গেস্টরুম’ করতে হয় শিক্ষার্থীদের।

তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ফজলুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সজীব চন্দ্র সরকার। তিনি বলেন, এ ধরনের প্রথা এখন আর এ হলে নেই। ৩-৪ বছর আগে ছিল বলে তাঁরা শুনেছেন।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঈশা খাঁ হল, শাহজালাল হল, শহীদ শামসুল হক হল, শহীদ নাজমুল আহসান হল, আশরাফুল হক হল, শহীদ জামাল হোসেন হল, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হল, ফজলুল হক হল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলের অন্তত ২৫ জন ছাত্র সরাসরি ও মুঠোফোনে ডার্কনাইট গেস্টরুম সম্পর্কে বলেছেন।

শিক্ষার্থীদের সবাই বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাদের অনুমোদন নিয়ে সংগঠনটির হলের দ্বিতীয় বর্ষের নেতা-কর্মীরা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ‘গেস্টরুম’ করান। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের প্রতি রাতে নয়টা থেকে সাড়ে নয়টার মধ্যে গেস্টরুমে যেতে হয়। শার্ট-প্যান্ট-জুতা পরে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত প্রত্যেকে দাঁড়িয়ে থাকেন। এক মিনিটের জন্যও বসার কোনো সুযোগ নেই। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে অ্যাম্বুলেন্সে করে মেডিকেল সেন্টারে পাঠানোরও নজির আছে।

গেস্টরুমে প্রথম সাত দিন কী করা যাবে, কী করা যাবে না তার ফর্দ মুখস্থ করিয়ে তা শোনা হয়। ফর্দের বড় অংশ জুড়ে আছে ছাত্রনেতাদের সালাম দেওয়ার নিয়মকানুন। ঈশা খাঁ হলের একজন শিক্ষার্থী বলেন, অনেক সময় নতুন শিক্ষার্থীরা একবার-দুবার দেখে দ্বিতীয় বর্ষের নেতাদের চিনতে পারেন না। কোনো কারণে সালামটা বাদ পড়ে গেলে গেস্টরুমে চড়-থাপ্পড়, স্টাম্প পেটা জুটবেই।

শিক্ষার্থীরা বলছিলেন, শুধু সালাম দিলেই হবে না, সালাম কতটা আন্তরিকভাবে দেওয়া হলো, সশব্দে দেওয়া হলো কি না, সেটাও বিবেচনা করা হয়। সালাম দেওয়ায় ভুলত্রুটি হতে পারে—এই আশঙ্কা থেকে অনেকে নিজের কক্ষ থেকে তেমন বের হতে চান না।

এর বাইরেও শিক্ষার্থীদের আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শ কী, কীভাবে স্লোগান দিতে হবে, তা শেখান নেতা-কর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসসির সামনে হেলিপ্যাড চত্বর, জব্বারের মোড় বা কে আর মোড়ে মিছিলে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। ছাত্রনেতারা ডাইনিংগুলো চালান। সে কারণে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ডাইনিং ছাড়া অন্য কোথাও খাওয়া নিষেধ। বাড়ি যাওয়ার আগে বা ক্যাম্পাস ছাড়ার আগে ‘ভাইদের’ কাছে শিক্ষার্থীদের ইচ্ছা প্রকাশ করতে হয়। কোনো কোনো হলে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসের ভেতর রিকশা বা সাইকেলে চড়া নিষেধ।

কেউ একাধিকবার নিয়ম ভঙ্গ করলে তাঁকে ‘সিঙ্গেল গেস্টরুম’-এর মুখোমুখি হতে হয়। এই ব্যবস্থায় প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীকে মারধরসহ নানাভাবে হেনস্তা করে ২০-২২ জনের একটি দল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলের একজন শিক্ষার্থী বলেন, তাঁকে ও তাঁর সহপাঠীদের নিয়মিত ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের প্র্যাকটিক্যাল (ব্যবহারিক) খাতার কাজ করে দিতে হয়। একেকজন নেতা তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন একেকজনকে দিয়ে কাজটি করান। এ জন্য তাঁরা সময় বেঁধে দেন। কখনো কখনো নেতা-কর্মীদের বান্ধবীদের খাতার কাজও করে দিতে হয় তাঁদের। নিজেদেরটা করে উঠতে না পারলেও ভাইদের কাজ থেকে মাফ নেই।

ব্যবহারিক কাজের পরিমাণ কেমন? মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের একজন অধ্যাপক বলেন, প্রতি সপ্তাহে একজন শিক্ষার্থীকে ছয় থেকে সাতটি কোর্সের ক্লাস করতে হয়। পরের সপ্তাহে সেই কোর্সগুলোর ওপর ব্যবহারিকের খাতা জমা দিতে হয়। প্রচুর ছবি আঁকতে হয়, লিখতেও হয়।

মাৎস্যবিজ্ঞান ও কৃষি অনুষদের পাঁচ শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাপসী রাবেয়া হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, সময়ের মধ্যে ভাইদের কাজটা যেন শেষ হয়, সে জন্য তাঁরাও মাঝে মাঝে বন্ধুকে সহযোগিতা করেন। অনেকে এসব নির্যাতন থেকে বাঁচতে রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে যান।

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সবুজ কাজী বলেন, ‘কাউকে বাধ্য করে কোনো কিছুই করানো হয় না। যারা রাজনীতি করতে চায় তারা স্বেচ্ছায় চলে আসে। গেস্টরুম বা নির্যাতন বিষয়ে কারও অভিযোগ থাকলে আমি কঠোরভাবে সেটি দেখব।’

অভিযোগ অস্বীকার করলেও ছাত্রলীগের জোরজবরদস্তির রাজনীতির নজির রয়েছে। গত ৪ আগস্ট ছাত্রলীগ নেতাকে সালাম না দেওয়ায় রাতভর এক শিক্ষার্থীর ওপর নির্যাতন চালান জামাল হোসেন হলে সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি কক্ষে অবৈধভাবে ছাত্র ওঠানোর বিরোধিতা করায় শাহজালাল হল থেকে এক ছাত্রকে বের করে দেওয়া হয়। গত পাঁচ বছরে এমন কমপক্ষে এক ডজন ঘটনা ঘটেছে।

মেয়েদের তাপসী রাবেয়া হল বাদে বাকি তিনটিতে অর্থাৎ সুলতানা রাজিয়া, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও বেগম রোকেয়ায় ছাত্রলীগ সক্রিয়। সব কটি হলেই ছেলেদের হলের আদলে গেস্টরুম কালচার চালু আছে, তবে মাত্রাটা কম।

গত বছরের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের মিছিলে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানানোয় রোকেয়া হলের শিক্ষার্থী আফসানা আহমেদকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। তাপসী রাবেয়া হলের প্রথম বর্ষের কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, তাঁদের ‘বড় আপু’দের সালাম দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। আছে ওয়াশরুম ও বেসিন ব্যবহারে বিধিনিষেধ। তাঁদের ডাইনিংয়ে খাওয়া বাধ্যতামূলক। একটি ব্লকের ১৬ জন বড় আপু চারটি বাথরুমে গোসল করতে পারলেও সংখ্যায় চার গুণ হয়েও তাঁদের জন্য বরাদ্দ দুটি। এক শিক্ষার্থী বলেন, তাঁর বন্ধু জ্বরের ঘোরে একদিন বড় আপুদের বাথরুমে মাথা ধুতে ঢুকলে শাস্তি হিসেবে ‘বড় আপু’ তাঁকে বাইরে থেকে আটকে দেন।

গত মে মাসে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়েছেন অধ্যাপক লুৎফুল হাসান। তাঁর দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ে হলের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। প্রভোস্ট হলের আসন বরাদ্দ দেন। এ বছর থেকে তাঁর সঙ্গে একটি টাস্কফোর্স কাজ করবে। তবে শিক্ষার্থীরা বলছেন, আসন বরাদ্দের ক্ষমতা এককভাবে ছাত্রলীগের। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে হল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ওয়াকিবহাল। তাঁরা আরও বলছেন, প্রশাসন যদি এই অভিযোগ অস্বীকার করে থাকে, তাহলে তারা প্রথম বর্ষের প্রথম সেমিস্টারের ফলাফল পর্যালোচনা করুক। একমাত্র যারা তাবলিগ করে, তারা ছাড়া গেস্টরুম কালচার থেকে কারও নিস্তার নেই। এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে ছাত্রদের পরীক্ষার ফলাফলে।

কৃষি অনুষদের এক ছাত্র বলেন, ভালো ফল করা ১ থেকে ১০-এর মধ্যে একজনও ছেলে নেই। মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের আরেক ছাত্র বলেন, এক বিষয়ে ফেল করেও হলে তাঁর ফলাফলই সবচেয়ে ভালো। কৃষি প্রকৌশলের এক ছাত্র বলেন, তিনি নিজে তিনটি বিষয়ে ফেল করেছেন, তাঁর বন্ধু নটর ডেম কলেজের ছাত্র ফেল করেছেন ছয়টি বিষয়ে। ক্লাস শেষে সন্ধ্যায় মিছিল-মিটিং এবং টানা তিন ঘণ্টা গেস্টরুম করে তাঁরা আর লেখাপড়া করার শক্তি পান না।

অসহায়ত্বের কথা জানিয়েছেন প্রভোস্ট কাউন্সিলের আহ্বায়ক অধ্যাপক শংকর কুমার দাশও। তিনি বলেন, আপাতদৃষ্টে প্রভোস্টের অনেক ক্ষমতা মনে হলেও আসলে তাঁদের সীমাবদ্ধতা অনেক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আন্তরিক সহযোগিতা না থাকলে তাঁরা কিছুই করতে পারেন না। অন্যদিকে উপাচার্য বলছেন, যেকোনো ঘটনা ঘটলে ছুটে যেতে হয়। সব প্রভোস্ট শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মেশেন না।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের অনেকেই বলেছেন, বহুদিন ধরে চলে আসা রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না হলে শিক্ষার্থীদের মুক্তি নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫০ জনের মতো। শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার, শিক্ষক ৫৮১ ও হল প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত শিক্ষক-কর্মকর্তাসহ আছেন ৫২ জন। সবাই মিলে চেষ্টা করলে অনাচারের সঙ্গে পেরে উঠবেন না, ব্যাপারটা এমন নয়। অভাবটা সাহস আর সদিচ্ছার।
//এআরএইচ//

Leave A Reply

Your email address will not be published.