Ultimate magazine theme for WordPress.

কলার চারা লাগানোর সর্বোত্তম সময়

আশ্বিন মাসের কৃষি

0

মাহবুবা আকতার : সারা বছর কলার চাষ হলেও আশ্বিন মাস হচ্ছে কলার চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়। অন্যদিকে আখ চাষীদের চারা উৎপাদনের উপযুক্ত সময় এই আশ্বিন মাস। মাছচাষীরা এই সময়ে পুকুরের যত্ম নেবেন। হাস-মুরগীকে প্রতিষেধক টিকা দেয়ার উপযুক্ত সময় এখন। এছাড়া যারা ফলজ কিংবা অন্যান্য গাছ লাগিয়েছেন তাদের এই সময়ে গাছগুলোর প্রতি যত্মশীল হতে হবে। আশ্বিন মাসের কৃষি ও কৃষকদের করনীয় নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্বে আজ কলা চাষের কৌশল তুলে ধরা হল।

বাংলাদেশের জনপ্রিয় ফল কলা অন্য সব ফলের তুলনায় সস্তা এবং সারাবছরই পাওয়া যায়। ভাদ্র মাস ছাড়া যে কোনো মাসেই চারা রোপণ করা যায়। তবে চারা রোপণের উপযুক্ত সময় হলো মধ্য আশ্বিন থেকে মধ্য অগ্রহায়ণ এবং মধ্য মাঘ থেকে মধ্য চৈত্র। তবে আশ্বিন মাসে কলার চারা রোপণ করা সবচেয়ে বেশি লাভজনক। এতে ১০-১১ মাসে কলার ছড়া কাটা যায়। ভাল উৎস বা বিশ্বসস্ত চাষি ভাইয়ের কাছ থেকে কলার অসি চারা সংগ্রহ করে রোপণ করতে হবে। তিন মাস বয়সী সুস্থ সবল অসি চারা লাগানো উত্তম।

জমি নির্বাচন : পর্যাপ্ত রস আছে এমন মাটিতে কলা চাষ করা যায়। তবে সুনিষ্কাশিত দো-আঁশ এবং বেলে দো-আঁশ মাটি কলা চাষের জন্য ভালো। এছাড়া জমি পর্যাপ্ত আলো বাতাসপূর্ণ হওয়া দরকার। অপরদিকে শীতকালে এবং প্রচুর আর্দ্রতাযুক্ত জলবায়ুতে কলা গাছের বৃদ্ধি ভালো হয়।

জাত নির্বাচন : বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের প্রায় ৪০-৫০টি জাতের কলার চাষ হয়ে থাকে। এসব জাতের মধ্যে অমৃতসাগর, সবরি, কবরি, চাঁপা, সিঙ্গাপুরি বা কাবুলী, মেহেরসাগর, এঁটে বা বিচি কলা, কাঁচকলা বা আনাজি কলা এবং জাহাজি কলা উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে বারিকলা-১, বারিকলা-২ ও বারিকলা-৩ নামে কলার তিনটি উন্নতজাত অবমুক্ত করা হয়েছে।

চারা নির্বাচন : কলার চারা বা সাকার দুই রকমের। অসি চারা ও পানি চারা। অসি চারার পাতা চিকন, গোড়ার দিকে মোটা ও গোলাকার। পানির চারার পাতা চওড়া, কাণ্ড চিকন ও দুর্বল। তবে চাষের জন্য অসি চারা লাগানো উত্তম।

চারা রোপণ : চারা রোপণের আগে ৫০ সেমি. দৈর্ঘ্য ৫০ সেমি. প্রস্ত এবং ৫০ সেমি. গভীর করে মাদা তৈরি করতে হবে। এক মাদা থেকে অপর মাদা বা এক চারা থেকে অপর চারার দূরত্ব রাখতে হবে ২ মিটার। এ হিসাবে বিঘাপ্রতি ৩৫০-৪০০টি চারা রোপণ করা যায়। কলার চারা রোপণের জন্য ২-২.৫ মিটার দূরত্বে ৬০ সেমি. চওড়া এবং ৬০ সেমি গভীর গর্ত করে রোপণ করতে হবে। গর্তপ্রতি ৫-৭ কেজি গোবর, ১২৫ গ্রাম করে ইউরিয়, টিএসপি ও এওপি সার এবং ৫ গ্রাম বরিক এসিড ভালভাবে মিশিয়ে৫-৭ দিন পর অসি চারা রোপণ করতে হবে। কলা বাগানে সাথি ফসল হিসেবে ধান, গম, ভুট্টা ছাড়া যে কোন রবি ফসল চাষ করা যায়।

সার ব্যবস্থাপনা : কলা চাষের জন্য জমি তৈরির শেষ সময় বিঘাপ্রতি ৩.৫-৪.০ টন পচা গোবর বা আবর্জনা পচা সার প্রয়োগ করতে হবে। এরপর পূর্ববর্তী পৃষ্ঠায় উল্লেখিত তালিকা অনুযায়ী সার ও সার জাতীয় খাদ্য উপাদান প্রয়োগ করতে হবে। লিবরেল দস্তা, লিবরেল বোরণ ও আলগা-গোল্ড কলাগাছের পাতায় ও ফলে সেপ্র করলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে। এসব খাদ্য উপাদান অন্যান্য সার বা বালাইনাশকের সাথে মিশিয়েও সেপ্র করা যাবে।

অতিরিক্ত চারা কর্তন : কলা গাছের গোড়া থেকে নতুন সাকার বা চারা বের হয়ে থাকে। কলার ছড়া বের হওয়ার আগ পর্যন্ত কলা গাছে নতুন চারা কোনো অবস্থাতেই রাখা উচিত নয়। সাধারণত দু-এক মাস পরপর এসব চারা মাটি সমান করে কাটা দরকার।

সেচ প্রদান ও পানি নিষ্কাশন : কলা গাছে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। কিন্তু গাছ অতিরিক্ত পানি সহ্য করতে পারে না। তাই পানি যাতে না দাঁড়ায় সেজন্য নিষ্কাশন নালা এবং শুকনো মৌসুমে সেচ নালা তৈরি করে তা দিয়ে দু-একবার সেচ দিতে হবে।

পোকামাকড় ও দমন : কলা চাষের অন্যতম শত্র্ব হলো এর বিটল পোকা, উইভিল ও থ্রিপস বা জাবপোকা। বিটল পোকা ফল ও পাতায় আক্রমণ করে। আক্রান্ত ফল ও পাতায় কালো বর্ণের গোল ও লম্বা দাগ দেখা যায়। ফল ছোট হয় এবং বাজারমূল্য কমে যায়। উইভিল পোকা কলার কন্দ ছিদ্র করে ভেতরে প্রবেশ করে ও নরম অংশ খেয়ে ফেলে। থ্রিপস বা জাবপোকা সাধারণত কলার খোসায় আক্রমণ করে এবং খোসার ওপর ছোট ছোট বাদামি লম্বা দাগ দেখা যায়। কলার উইভিল পোকা দমনের জন্য চারা রোপণের সাড়ে তিন থেকে চার মাস পর বিঘাপ্রতি ৩ কেজি হারে নিউফুরান-৫ জি অন্যান্য সারের সাথে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া ফল ও পাতার বিটল পোকা দমনের জন্য আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১০ মিলি মর্টার-৪৮ ইসি প্রতি ১০-১৫ দিন পর পর সেপ্র করতে হবে।

রোগ ও প্রতিকার : কলার রোগের মধ্যে পানামা, সিগাটোকা ও গুচ্ছমাথা রোগ অন্যতম। পানামা রোগের আক্রমণে গাছের পাতা হলুদ হয়, পাতা বোঁটার কাছে ভেঙে ঝুলে যায় এবং কাণ্ড অনেক সময় ফেটে যায়। আক্রান্ত গাছ আস্তে আস্তে মরে যায় অথবা ফুল ও ফল ধরে না।
সিগাটোকা রোগের আক্রমণে পাতার ওপর গোলাকার বা ডিম্বাকৃতির গাঢ় বাদামি রঙের দাগ পড়ে। ফল ছোট আকারের হয় এবং গাছের ফলন বহুলাংশে কমে যায়। গুচ্ছ মাথা রোগে আক্রান্ত গাছের পাতা সর্ব এবং ফ্যাকাশে রঙের হয়। জাব পোকা ও জ্যাসিডের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। পানামা ও সিগাটোকা রোগ থেকে প্রতিকারের জন্য প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৫ মিলি. এন্টিসিকা ও ১০ গ্রাম বেনডাজিম অথবা ২০ গ্রাম হেমেঙিল এমজেড-৭২ ডব্লিউপি একত্রে মিশিয়ে সেপ্র করতে হবে। গুচ্ছ মাথা রোগ এক ধরনের ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়।
জাবপোকা জ্যাসিড এই ভাইরাস বিভিন্ন গাছে ছড়ায়। জাবপোকা দমনের জন্য প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০ মিলি. স্টার্টার ৪০ ইসি সেপ্র করতে হবে। এছাড়া রোগমুক্ত এবং রোগ সহনশীল জাতের সাকার চাষ করেও এসব রোগের হাত থেকে রৰা পাওয়া যায়।
//এআরএইচ//
লেখক : উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, মেট্রোপলিটন কৃষি অফিস, উত্তরা, ঢাকা।

Leave A Reply

Your email address will not be published.