Ultimate magazine theme for WordPress.

আখের চারা উৎপাদন ও জমির তৈরির এখনই সময়

আশ্বিন মাসের কৃষি

0

মাহবুবা আকতার : আখ আমাদের দেশের একটি জনপ্রিয় অর্থকরি ফসল। চিনি উৎপাদনের মূল ফসল। আখের রসে রয়েছে প্রচুর পুষ্টিগুণ। প্রতি ১০০ গ্রাম আখের রসে ৩৯ ক্যালরি, ৯ দশমিক ১ গ্রাম শর্করা, আমিষ চর্বি, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ পাশাপাশি রিবোফ্লোবিন এবং ক্যারোটিন বিদ্যমান। পরিপক্ক আখে শতকরা ৮০ ভাগ পানি, ৮-১৬ ভাগ সুক্রোজ, শূণ্য দশমিক ৫-২ ভাগ রিডিউসিং সুগার এবং শূণ্য দশমিক ৫-১ নন সুগার থাকে। আশ্বিন মাস হচ্ছে আখের চারা উৎপাদন করার উপযুক্ত সময়। মাছচাষীরা এই সময়ে পুকুরের যত্ম নেবেন। হাস-মুরগীকে প্রতিষেধক টিকা দেয়ার উপযুক্ত সময় এখন। এছাড়া যারা ফলজ কিংবা অন্যান্য গাছ লাগিয়েছেন তাদের এই সময়ে গাছগুলোর প্রতি যত্মশীল হতে হবে। আশ্বিন মাসের কৃষি ও কৃষকদের করনীয় নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের চতুর্থ পর্বে আজ আখ চাষের কৌশল তুলে ধরা হল।

জাত নির্বাচন : খরা, বন্যা, জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততাসহ প্রতিকূল পরিবেশে ঈশ্বরদী ২০, ঈশ্বরদী ২১, ঈশ্বরদী ২২, ঈশ্বরদী ২৪, ঈশ্বরদী ২৫, ঈশ্বরদী ২৬, ঈশ্বরদী ২৭, ঈশ্বরদী ২৮, ঈশ্বরদী ২৯, ঈশ্বরদী ৩০, ঈশ্বরদী ৩১, ঈশ্বরদী ৩২, ঈশ্বরদী ৩৩, ঈশ্বরদী ৩৪, ঈশ্বরদী ৩৭, ঈশ্বরদী ৩৮, ঈশ্বরদী ৩৯ ও ঈশ্বরদী ৪০ জাতের আখ চাষ করা করলে বেশি লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বীজ নির্বাচন : প্রত্যায়িত ইক্ষু বীজ ক্ষেত থেকে অনুমোদিত জাত বীজ হিসাবে নির্বাচন করতে হবে। সাধারণতঃ ৮-৯ মাস বয়সের অপরিপক্ক বীজ ইক্ষু চাষের জন্য ভাল। এ বয়সে ইক্ষুর চোখগুলো সতেজ থাকে এবং ইক্ষুর কান্ডে নাইট্রোজেন ও গ্লুকোজের পরিমান বেশী ও চিনির পরিমান কম াকায় চোখগুলো তাড়াতাড়ি গজায়। এ ছাড়াও রোগ/পোকা-মাকড় মুক্ত বীজ ইক্ষু চাষের জন্য উত্তম।

গাছের যে অংশে শিকড় বের হয়েছে তা বীজ হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না। ইক্ষু বৃদ্ধির শেষ পর্যায়ে মোটা তাজা ও রসালো বেশ কিছু কুশি বের হয় এদেরকে ওয়াটার শুট (ডধঃবৎ ংযড়ড়ঃ) বলা হয়। এগুলো বীজ হিসাবে সর্বোত্তম। তাছাড়া ইক্ষুর ডগা বীজ হিসাবে ভাল। পরিপক্ক ইক্ষু বীজ হিসাবে ব্যবহার করলে ইক্ষু কান্ডের আগার দিক থেকে তিন ভাগের দুই ভাগ ব্যবহার করা যাবে। মুড়ি ইক্ষু ক্ষেত থেকে বীজ সংগ্রহ না করাই ভাল। বীজ ইক্ষু পাতাসহ পরিবহন করতে হবে যাতে চোখগুলো নষ্ট না হয়।

বীজ তৈরি: নির্বাচিত বীজ ইক্ষু কাটার সময় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। যে দা বা হাসুয়া দিয়ে বীজ ইক্ষু কাটা হয় তা মাঝে মাঝে আগুনে পুড়িয়ে/ঝলসিয়ে বা রাসায়নিক পদার্থে (শতকরা ৫ ভাগ ’লাইসল’ দ্রবনে) ডুবিয়ে জীবানুমুক্ত করে নেওয়া দরকার। বীজ ইক্ষু কাটার সময় রোগ ও পোকা-মাকড় যুক্ত কান্ড বাদ দিতে হবে। ইক্ষু বীজ বিভিন্নভাবে তৈরী করা যায়। যেমন- তিন চোখ বিশিষ্ট বীজ খন্ড। দুই চোখ বিশিষ্ট বীজ খন্ড। এক চোখ বিশিষ্ট বীজ খন্ড। সনাতন পদ্ধতিতে ইক্ষু রোপণের জন্য ভাল হাসুয়া দিয়ে তিন চোখ বিশিষ্ট বীজ খন্ড তৈরী করে বীজ খন্ড নালায় পাশাপাশি চোখ রেখে মাথায় মাথায় রোপণ করতে হবে।
বীজ খন্ডে লেগে থাকা অথবা মাটিতে অবস্থিত রোগ জীবানু হতে বীজকে রক্ষা করার জন্য রোপণের পূর্বে বীজ শোধন করা প্রয়োজন। বীজ খন্ড তৈরী করে ১ লিটার পানিতে ১ গ্রাম ব্যাভিষ্টিন দ্রবনে ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রেখে বীজ খন্ড শোধন করতে হবে এবং পরে বীজ খন্ড মূল জমিতে রোপণ অথবা চারা উৎপাদনের জন্য বীজ তলায় স্থাপন করতে হবে। প্রতি টন (১০০০ কেজি) বীজ ইক্ষুর জন্য ১০০ গ্রাম ব্যাভিষ্টিন প্রয়োজন।

চারা উৎপাদন : সাধারণত বীজতলা পদ্ধতি এবং পলিব্যগ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করা যায়। তবে পলিব্যাগে চারা উৎপাদন করা হলে বীজ আখ কম লাগে এবং চারার মৃত্যুহার কম হয়। চারা তৈরি করে বাড়ির আঙিনায় সুবিধাজনক স্থানে সারি করে রেখে খড় বা শুকনো আখের পাতা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। চারার বয়স ১-২ মাস হলে মূল জমিতে রোপণ করতে হবে।

জমি নির্বাচন : উচু ও মাঝারী উঁচু জমি যেখানে বন্যা বা বৃষ্টির পানি জমে না সে সব জমি ইক্ষু চাষের জন্য উপযোগী। তবে বালি মাটি ছাড়া যে কোন ধরনের মাটিতেই সফল ভাবে ইক্ষু চাষ করা যায়। এঁটেল, দোআঁশ ও এঁটেল-দোআঁশ মাটিতে আখ ভাল জন্মে। তবে পানি নিকাশের ব্যবস্থাযুক্ত এঁটেল-দোআঁশ মাটি সবচেয়ে ভাল। উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি যেখানে পানি জমে থাকে না এমন জমি নির্বাচন করতে হবে।

জমি তৈরি : প্রতি হেক্টরে ইউরিয়া ১২০-১৫০ কেজি, টিএসপি ৮০-১১০ কেজি, এমওপি ১১০-১৪০ কেজি, জিপসাম ৫০-৬০ কেজি, জিংক সালফেট ১০-১৫ কেজি, ডলোচুন ১০০-১৫০ কেজি, জৈব সার ২-৩ টন প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া ও এমওপি সার ছাড়া অন্যান্য সব সার শেষ চাষের সময় মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। অর্ধেক ইউরিয়া ও এমওপি রোপণ নালায় দিতে হবে। বাকি ইউরিয়া ও এমওপি চারা রোপণের পর কুঁশি গজানো পর্যায়ে (১২০-১৫০ দিন) উপরি প্রয়োগ করতে হবে।

নালা তৈরী : নালার গভীরতা ৮-৯ ইঞ্চি (২০-২৫ সেমি) হওয়া উত্তম। আখের বিভিন্ন রোপণ পদ্ধতি যেমন একসারি এবং জোড়াসারির জন্য বিভিন্নভাবে নালা তৈরী করা যায়। একসারি পদ্ধতির ক্ষেত্রে ট্রাক্টর, ট্রেঞ্চার, পাওয়ার টিলার, গরুর সাহায্যে লাঙ্গল দিয়ে, কোদাল দিয়ে আখ খেতের নালা তৈরি করা যায়।

রোপণের সময় : জানুয়ারী মাস ছাড়া বাংলাদেশে অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত চারা রোপন করা যায়। তবে চারা রোপণের সর্বোত্তম সময় মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য ডিসেম্বর। ৩০-৩৫ হাজার কাটিং বা সেট/হেক্টর বীজ প্রয়োজন হয়।

রোপণ পদ্ধতি : সমতলী পদ্ধতিতে নালা তৈরি করে নালায় ৫-৬ ইঞ্চি গভীরে রোপণ করা হয়। সমতলী পদ্ধতির চেয়ে কিছুটা গভীর নালা তৈরি করে ভাওড় পদ্ধতিতে ৮-১০ গভীরে রোপণ করা হয়। পরিখা বা নালা পদ্ধতিতে খননকৃত নালায় একটি কেন্দ্র থেকে অন্যটির কেন্দ্রের দূরত্ব ১০০-১২০ সেমি.। নালায় গভীরতা ৩০ সেমি. উপরের প্রস্থ ৩০ সেমি এবং নিচের প্রস্থ ২৫ সেমি। নালার নিচের দিকে ৫-৭ গভীরতায় বীজ আখ রোপণ করা হয় এবং উপরের মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। রোপা পদ্ধতিতে এক চোখ বিশিষ্ট আখ খন্ড পলিথিন ব্যাগে কিংবা দুই চোখ বিশিষ্ট আখ খন্ড বীজতলায় রোপণ করে চারা করে সেই চারা মূল জমিতে রোপণ করা হয়।

নালায় সার প্রয়োগ ও ব্যবস্থাপনা : রোপা ও প্রচলিত পদ্ধতির জন্য হেক্টর প্রতি একই পরিমান সার প্রয়োগ করতে হয়। তবে সার প্রয়োগ পদ্ধতির মধ্যে কিছুটা তারতম্য রয়েছে। বিভিন্ন কৃষি পরিবেশ অঞ্চলের জন্য বিভিন্ন সারের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সে মোতাবেক জমিতে সার প্রয়োগ করতে হবে। সমস্ত টিএসপি, জিপসাম, জিঙ্কসালফেট এবং ১/৩ ভাগ এমপি সার বীজখন্ড/চারা রোপণের পূর্বে নালায় প্রয়োগ করে ভালভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। রোপা আখ চাষের ক্ষেত্রে চারা রোপণের ১৪ থেকে ২১
দিন পর ১/৩ ভাগ ইউরিয়া চারার গোড়ায় প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে ও মাটি আলগা করে দিতে হবে। অবশিষ্ট ২/৩ ভাগ ইউরিয়া ও এমপি সার সমান দুই কিস্তিতে প্রাথমিক কুশি বের হওয়ার সময় ও কুশি বের হওয়ার শেষ পর্যায়ে প্রয়োগ করে গাছের গোড়ায় মাটি দিতে হবে।

আন্তঃপরিচর্যা : গাছ যাতে হেলে না পড়ে সেজন্য আখ গাছ বেঁধে দিতে হবে। আখের শুকনা পাতা ঝরে পড়ে না বলে শুকনা পাতা ছিঁড়ে ফেলতে হয়। মাটিতে বাতাস চলাচলের জন্য মাটি আলগা করে দেয়া দরকার এবং ২/৩ বার আগাছা দমন করতে হয়। গাছের বয়স ৭/৮ সপ্তাহ হলে প্রথমবার এবং ১২-১৪ সপ্তাহ হলে কাণ্ডে ২-১টি গিঁট দেওয়ার পর দ্বিতীয়বার মাটি দিতে হবে। প্রয়োজন হলে বাঁশের সাহায্যে আখ গাছ ঠেস দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রথমে প্রতিটি আড় শুকনা পাতা দিয়ে বেঁধে পাশাপাশি দুই সারির ৩-৪ টি ঝাড় একত্রে বেঁধে দিতে হবে। আখ দীর্ঘজীবি ফসল বিধায় জমিতে প্রয়োজন অনুসারে সেচ দিতে হবে।

আগাছা পরিস্কার ও মাটি আলগাকরন : আখ রোপণের পর জমিতে জোঁ এলে মাটি আলগা করে দিতে হবে। মাটি আলগা করনের সময় ক্ষেতে আগাছাগুলো (রোপণের পর ১২০-১৩৫ দিন পর্যন্ত) পরিস্কার করে দিতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে যে, আখের কুশি সৃষ্টিকালীন সময়ে অতিরিক্ত মাটি চারার গোড়ায় না পড়ে। এতে কুশি সৃষ্টি বিঘœ ঘটে।

সারের উপরি প্রয়োগ : কুশি বের হওয়া শুরুত্ব হলে প্রথম কিস্তি ইউরিয়া ও এমওপি সার উপরি প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয় দফা সার কুশি বের হওয়া সম্পন্ন হলে উপরি প্রয়্গো করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। রোপা আখের ক্ষেত্রে চারা রোপণের ২১-৩০ দিন পর ১/৩ ভাগ ইউরিয়া চারার গোড়ায় প্রয়োগ করতে হবে।

পোকামাকড় ও রোগ ব্যবস্থাপনা : আখের ডগা মাজরা পোকা ও কান্ডের মাজরা পোকা দমনে আখের সারির দুই পাশে নালা কেটে হেক্টর প্রতি ৪০ কেজি পিলার ফুরান/ ফুরাডান ৫জি বা ফুরাটায় ৫জি প্রথমবার মার্চ মাসে ও দ্বিতীয়বার মে মাসে প্রয়োগ করে মাটি ঢেকে দিয়ে সেচ দিতে হবে। উঁইপোকা রোপণকৃত আখখন্ড খেয়ে ফেলে, ফলে চারা গজাতে পারে না। গাছে আক্রমণ করলে গাছ শুকিয়ে যায়। দমনের জন্য মুড়ি আখ চাষ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। উঁইপোকার ডিবি ভেঙ্গে রাণী খুঁজে মেরে ফেলা সহ পাটকাঠির ফাঁদ দিতে হবে। ভিটাশিল্ড/লিথাল ২০ ইসি প্রয়োগ করা।

ছত্রাক দমনে করনীয় : এক ধরনের ছত্রাকের কারণে আখের লাল পচা রোগ হয়। আক্রান্ত আখের কান্ডকে লম্বালম্বি চিড়লে ভেতরের কোষগুলো পচে ফ্যাকাসে লাল রঙ দেখায়। এ জন্য রোপণের বীজ শোধন করতে হবে। ফরাস্টিন ৫০ এসপি হেক্টর প্রতি ৫০০ গ্রাম প্রয়োগ করা উচিত।

ফসল সংগ্রহ : আখ পরিপক্ক হতে সাধারণত ১২-১৫ মাস সময় লাগে। হেক্টর প্রতি গড় ফলন ৪৫-৭৫ টন।
//এআরএইচ//
লেখক : উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, মেট্রোপলিটন কৃষি অফিস, উত্তরা, ঢাকা।

Leave A Reply

Your email address will not be published.