Ultimate magazine theme for WordPress.

শেষ মুহূর্তের পরিচর্যায় ব্যস্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষিরা

0

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি : গাছে গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে গোপালভোগ, খিরসাপাত, ল্যাংড়া, ফজলি, আশ্বিনা, লখনা, হিমসাগরসহ বিভিন্ন জাতের আম। এ চিত্র এখন আমের রাজধানী খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জের সব আমবাগানেই। আর সপ্তাহ তিনেক পরেই বাজারে উঠতে শুরু করবে মৌসুমি এই ফল। সেই সঙ্গে রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে আম পাকানো ঠেকাতে সম্প্রতি উচ্চ আদালতের নির্দেশে বাগানগুলোতে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি থাকায় এবার আম পাড়ার সময়সীমা বেঁধে না দেওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষিরা খুশি হয়েছেন। শেষ মুহূর্তের পরিচর্যায় তাই ব্যস্ত এখানকার বাগান মালিক ও আমচাষিরা।

তবে বাগান মালিক ও আমচাষিরা বলছেন, বাগানগুলোতে এবার সময়মতো মুকুল আসলেও অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিপাতে মুকুল ঝরে যাওয়া, গুটি অবস্থায় ‘মিজ’ পোকার আক্রমণ, শিলাবৃষ্টি, চলমান দাবদাহ ও বৈরী আবহাওয়ায় গেলোবারের চেয়ে এবার জেলায় আমের উৎপাদন অনেকটাই কম। এতে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি, লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়া ও বাজারদর নিয়ে শঙ্কার কথাও জানিয়েছেন বাগান মালিক ও আমচাষিরা।

সরেজমিন জেলার শিবগঞ্জ ও সদর উপজেলার বেশ কয়েকটি আমবাগান ঘুরে বাগান মালিক ও চাষিদের সঙ্গে কথা বললে এমনটাই জানিয়েছেন তারা। যদিও কৃষি বিভাগের দাবি, সামনে আর নতুন কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা না দিলে উৎপাদনে তেমন কোনও প্রভাব পড়বে না।

এ বছর জেলার পাঁচ উপজেলায় ৩১ হাজার ৮২০ হেক্টর জমির বাগান থেকে ২ লাখ ৭৫ হাজার টন আমের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ।

শিবগঞ্জের আমচাষি আহসান হাবীব জানান, ‘এবার বিভিন্ন বিপর্যয়ে আমের উৎপাদন অনেকটাই কম। শিলাবৃষ্টি ছিল, মৌসুমের শুরুতেই মুকুলে ও আমের গুটি অবস্থায় মিজ পোকার আক্রমণ ছিল। সেইসঙ্গে অনাবৃষ্টি ও দাবদাহ ছিল। আবার শতভাগ মুকুল আসলেও সঠিক পরিচর্যার অভাব ও পরাগায়ন না হওয়ায় আমের গুটি কম আসে। যার ফলে গতবারের চেয়ে এবার উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসবে।’

আমচাষি ইব্রাহিম আলী জানান, ‘২০-২৫ দিন আগে গুটি অবস্থায় আমে মিজ পোকার আক্রমণে আমের উৎপাদনে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। পরে ফণীর কারণে বৃষ্টি হলে প্রচণ্ড দাবদাহ অবস্থায় কিছুটা হলেও আমের জন্য উপকার বয়ে আনে। আর সপ্তাহ তিনেক পরেই বাজারজাত শুরু হবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের। তবে বাজারদর কী হবে তা আমরা এখনই বলতে পারছি না। এ নিয়ে আমরা শঙ্কায় আছি। এবার ভালো দাম না পেলে অন্যান্য বছরের মতো আমরা চাষিরা আবারও মারা যাবো। এতে আগামীতে আম উৎপাদনে অনাগ্রহ তৈরি হতে পারে চাষিদের মাঝে।’

শিবগঞ্জ পুঠিমারী এলাকার আমচাষি আবদুল লতিফ জানান, ‘আমের শেষ মুহূর্তের পরিচর্যা ও বাজারজাতের প্রস্তুতি নিচ্ছি। এই মুহূর্তে আমরা বাগানগুলোতে জোগানদার নিয়োগ দিচ্ছি, যাতে কেউ আম চুরি করতে না পারে। গাছের নিচের ঘাস পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করছি। নিরাপদ আম উৎপাদনে ফ্রুট ব্যাগিং করছি। আর সপ্তাহ তিনেক পরেই যেহেতু এসব আম বাজারজাত করা হবে, তাই পরিচর্যার পাশাপাশি চেষ্টা করছি শেষ মুহূর্তে যাতে পোকামাকড় ও আর কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমাদের আমগুলো নষ্ট না হয়। এখন বাগানে যে পরিমাণ আম আছে সেগুলো যাতে ভালো থাকে এবং ভালো দামে বাজারজাত করতে পারি।’

আমবাগান ঘুরে বাগান মালিক ও আমচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছর ব্যাপক শিলাবৃষ্টি ও ঝড়ের কারণে আমচাষিরা ব্যাপক লোকসানে পড়েন। এ বছর বড় ধরনের ঝড় বা শিলাবৃষ্টি তেমন একটা না হলেও এখন পর্যন্ত বাগান বেচাকেনা তেমন নেই। তাই কেউ কেউ বাড়তি পরিচর্যা করলেও বেশিরভাগ আমচাষি বাগান ও আমের বাড়তি পরিচর্যা করছেন না। শিবগঞ্জের আম ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন শামীম খান জানান, ‘এরকম তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকলে গুটি জাতের কিছু কিছু আম ২৫ মের দিকে উঠে যেতে পারে। নাহলে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে বাজারে আসবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম।’

এদিকে আমের বাজার ও বাগানগুলো মনিটরিং শুরু করেছে স্থানীয় প্রশাসন। অপরিপক্ব আম পেড়ে রাসায়নিক বা কেমিক্যাল দিয়ে কেউ যাতে না পাকাতে পারে সেজন্য বাড়ানো হয়েছে নজরদারিও। এ ব্যাপারে আমচাষি আবদুর রহিম জানান, ‘গত কয়েক বছর ধরে আম পাড়ার সময়সীমা বেঁধে দেওয়ায় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ বছর যেহেতু প্রশাসনের নজরদারি আছে সেহেতু এ সময়সীমা বেঁধে না দেওয়াই ভালো হয়েছে আমাদের জন্য।’ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘তাপমাত্রা ও আবহাওয়ার কারণে আম অনেক সময় নির্দিষ্ট সময়ের আগেই পেকে যায়। কিন্তু প্রশাসনের সময় বেঁধে দেওয়ায় কয়েক বছর ধরে আমরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। যার কারণে আমচাষিরা আম উৎপাদনে অনেকটাই আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। আগের মতো আর বাগানের পরিচর্যাও করছে না কেউ। আর বর্তমানে যে দাবদাহ চলছে তাতে সময়ের আগেই এবার আম পেকে যেতেও পারে।’

তবে আমচাষি ও বাগান মালিকরা শঙ্কায় থাকলেও কৃষি বিভাগের দাবি, ‘সামনে আর নতুন কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা না দিলে সার্বিক উৎপাদনে তেমন কোনও প্রভাব পড়বে না। চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপপরিচালক ড. মো. সাইফুল আলম জানান, ‘এবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কিছুটা হলেও জেলায় আমের উৎপাদন কম হয়েছে। তবে যেহেতু এ বছর আম চাষের এলাকা বৃদ্ধি পেয়েছে সেহেতু লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তেমন প্রভাব পড়বে না। আর রোজার পরই এসব আম বাজারজাত হওয়ার কারণে এবার কৃষকরা ভালো দাম পাবেন বলেও আশা করছি।’

আমের ভালো ফলন নিশ্চিতে ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ থেকে আম রক্ষায় বাগান মালিক ও চাষিদের বালাইনাশক স্প্রেসহ নানা পরামর্শ দিচ্ছেন ফল গবেষকরা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শফিকুল ইসলাম জানান, ‘আম বাজারজাত ও সংগ্রহ শুরু না হওয়া পর্যন্ত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শঙ্কা থেকেই যায়। এখন কৃষকদের করণীয় হলো আমগুলোকে ভালোভাবে সুরক্ষার জন্য এবং কাঙ্ক্ষিত মানের করতে দু’একটি বালাইনাশক স্প্রে করা যেতে পারে আম সংগ্রহের অন্তত ১৫ দিন আগে। এছাড়া সামনে জুন মাসের বৃষ্টিতে নাবী জাতের আমের গায়ের কালো দাগ দূর করতে এবং ফ্রুট ফ্লাইয়ের আক্রমণ থেকে আম রক্ষায় ব্যাগিংয়ের পরামর্শ দিচ্ছেন ফল গবেষকরা।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক এজেডএম নূরুল হক জানান, ‘চলতি বছর যেহেতু উচ্চ আদালতের নির্দেশে ক্ষতিকর রাসায়নিক দিয়ে কেউ যাতে অপরিপক্ব আম পাকাতে এবং গুদামজাত করতে না পারে সেজন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেহেতু এ বছর আম পাড়ার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হচ্ছে না। দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে চাই, এবার ভোক্তারা বিষমুক্ত ও নিরাপদ আম খেতে পারবেন কোনও শঙ্কা ছাড়াই।’

অন্যদিকে, মৌসুমের শুরুতে গোপালভোগ ও খিরসাপাত আমের দাম পাওয়া ও বাজারজাতকরণ নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মঞ্জুরুল হুদা। তিনি জানান, ‘সাধারণত ২৫ থেকে ৩০ মে’র মধ্যেই গোপালভোগ এবং জুনের প্রথম সপ্তাহ থেকেই খিরসাপাত আম বাজারজাত শুরু হয়। কিন্তু ঈদের আগে ও পরে ছুটির কারণে সবকিছু স্বাভাবিক হতে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ লেগে যেতে পারে। এই সময়ে পরিবহন ও ভোক্তা সংকটে পড়তে পারে আমের বাজার। আর বর্তমানে যে বিরূপ আবহাওয়া তা চলমান থাকলে হয়তো নির্দিষ্ট সময়ের আগেই আম পেকে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ভোক্তা ও ক্রেতার অভাবে দেশব্যাপী আম বাজারজাত ও পরিবহনে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে এবং গাছে আম পেকে নষ্ট হতে পারে। ফলে কৃষকের আমের ন্যায্য দাম না পাওয়ার শঙ্কা কিছুটা রয়েছে।’
//এআরএইচ//

Leave A Reply

Your email address will not be published.