কৃষিখবর প্রতিবেদক : বাংলাদেশের জিডিপিতে ইলিশের অবদান এক শতাংশের বেশি। গত অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশই ছিল ইলিশ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর উৎপাদন বেড়েই চলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মা ইলিশ সুরক্ষা ও ডিম ছাড়ার পরিবেশ সৃষ্টি করা, জাটকা নিধন কার্যক্রম, ইলিশের অভয়াশ্রম চিহ্নিতকরণ, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ বহুমুখী পদক্ষেপের কারণে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ দশমিক ৯৮ লাখ মেট্রিক টন, যা গত ৯ বছরে ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৫ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে।
মৎস্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০২-০৩ অর্থ বছরে দেশে উৎপাদিত ইলিশ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ৫ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে গেছে। প্রতি কেজি ইলিশের দাম কমপক্ষে ৫০০ টাকা ধরে হিসাব করলে ৫ লাখ মেট্রিক টন ইলিশের বাজারমূল্য ২৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এই বাজারের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আগামী ১০ থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত (৭ দিন) জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ পালন করবে সরকার।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ১০ বছর আগেও দেশের মাত্র ২১টি উপজেলার নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। এখন ইলিশ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের ১২৫টি উপজেলার নদীতে। বিশ্বের মোট ইলিশের ৭৫ শতাংশই উৎপাদিত হচ্ছে বাংলাদেশে।
মৎস্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৪-০৫ থেকে ২০০৭-০৮ সাল পর্যন্ত জাটকা আহরণ নিষিদ্ধিকালীন সময়ে প্রতিটি জেলে পরিবারতে মাসে ১০ কেজি হারে খাদ্য দেওয়া হলে বর্তমানে ৪০ কেজি হারে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ২০০৭-০৮ সালে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৩৫টি জেলে পরিবার এই কর্মসূচির অন্তর্ভূক্ত থাকলেও বর্তমানে পরিবারসংখ্যা ২ লাখ ৪৮ হাজার ৬৭৪-তে উন্নীত হয়েছে।
বর্তমান সরকারের আমলে প্রকৃত জেলেদের শনাক্ত করতে জুন ২০১৭ পর্যন্ত ১৬ লাখ ২০ হাজার মৎস্যজীবী-জেলেদের নিবন্ধন ও ডাটাবেজ প্রস্তুত এবং ১৪ লাখ ২০ হাজার জেলেকে পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে ইলিশ আহরণে জড়িত প্রায় ৭ লাখ জেলে এবং মা-ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধকালে ২২ দিনের জন্য ৩ লাখ ৯৫ হাজার জেলে-পরিবারের প্রতিটিকে ২০ কেজি হারে প্রায় ৭ হাজার টন খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়। এছাড়াও ইলিশ উৎপাদনের সফলতা ধরে রাখার জন্য দেশের ১৫টি জেলায় ২ লাখ ২৪ হাজার ১০২টি জেলে পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছে সরকার।
মৎস্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন নদীতে ইলিশ ধরা পড়লেও বিশেষ করে চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর হচ্ছে ইলিশ অধ্যুষিত জেলা। এই জেলাগুলোর আশপাশের নদীগুলোকে কেন্দ্র করেই গড়ে তোলা হয়েছে ইলিশের অভয়ারণ্য। সাগর থেকে ইলিশের ঝাঁক এসব জেলার আশপাশের নদীগুলোয় এসেই ডিম ছাড়ে। একটি মা-ইলিশের পেটের দুই ফালি ডিম থেকে সর্বনিম্ন দেড় লাখ এবং সর্বোচ্চ ২৩ লাখ পর্যন্ত ডিম হয়। ভোলা জেলার মনপুরা, ঢালচর, নোয়াখালী জেলার হাতিয়া কালিরচর ও মৌলভীরচরকে ইলিশের বিশেষ প্রজনন এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পদ্মাসহ চাঁদপুরের মেঘনা, ভোলার তেতুলিয়া, বরিশালের কীর্তনখোলা, পটুয়াখালীর পায়রা, আগুনমুখা, পিরোজপুরের বলেশ্বর এবং সন্ধ্যা নদীর মাছের স্বাদ সবচেয়ে বেশি।
সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদফতর প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও আইনানুগ কার্যক্রম শেষে বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশের ভৌগোলিক নিবন্ধন (জিআই সনদ) প্রদান করে। ভৌগোলিক নিবন্ধন সম্পন্নের ফলে এখন মানসম্পন্ন ইলিশ বাজারজাতকরণের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে বাণিজ্যিকসহ অন্যান্য সুবিধা পাওয়া যাবে।
এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু জানান, ইলিশ জাতীয় সম্পদ। এই সম্পদ রক্ষায় সবার এগিয়ে আসা প্রয়োজন। জাটকা সংরক্ষণ ও ইলিশকে ডিম ছাড়ার সুযোগ দিতে হবে। আগামী ১০ থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত এক সপ্তাহ জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ ঘোষণা করা হয়েছে। এই সময়ে জাটকা ধরা ঠেকাতে অভিযান চালানো হবে। সরকারের নির্দেশ অমান্য করলে শাস্তি অবধারিত বলেও জানিয়েছেন তিনি।
//এআরএইচ//