কৃষিখবর ডেস্ক : দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যকার চলমান যুদ্ধের প্রভাবে সম্ভাব্য বিশ্বময় খাদ্য সংকট মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী রমজান মাস পর্যন্ত দেশে কোনও ধরনের খাদ্য সংকট হবে না। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। খবর বাংলাট্রিবিউন ডটকম।
সূত্র জানিয়েছে, কৃষি সচিবের নেতৃত্বে সরকারের শীর্ষমহল খাদ্য নিয়ে গত ছয় মাস ধরে সমন্বয় করছেন। সেখানে জানানো হয়েছে, এই বোরো মৌসুম শেষ হয়ে গেলে আগামী মে মাস পর্যন্ত খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকবে। আগামী রমজান পর্যন্ত আমাদের দেশে কোনও খাদ্য সংকট হবে না বলে জানানো হয়েছে। বর্তমানে যে খাদ্য মজুত আছে, সেটা ছাড়াও এবার আমনের ফলনও ভালো হয়েছে। এ বছরের খরা দীর্ঘায়িত হওয়ায় সুবিধা হচ্ছে যে নিম্নাঞ্চলেও আমন চাষ করা গেছে। সূর্যের আলো বেশি থাকায় সালোকসংশ্লেষণ ভালো থাকায় ফসল ভালো হয়েছে। এবারের বোরো ধানে খুব একটা চিটাও দেখা যায়নি।
এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় ১৭টি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য করণীয় হচ্ছে— ফসলের উৎপাদন খরচ কমানো, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, আবাদি জমি বাড়ানো, প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহনশীল জাত উদ্ভাবন, জলবায়ু পরিবর্তন উপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবন, আন্তফসল, মিশ্র ফসল, রিলেফসল, রেটুন ফসল চাষ করা, সেচের জমি বৃদ্ধি করা, উফশী ও হাইব্রিড ফসল চাষ করা, শস্য বহুমুখীকরণ করা, জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুত ও প্রচুর চারা উৎপাদন করা, রোগবালাই দমন করা। প্রতি ইঞ্চি জমি চাষ করা। ধানক্ষেতে মাছ চাষ, পুকুরে মাছ-মুরগি-হাঁসের সমন্বিত চাষ করা, রোগ ও পোকা দমনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা, সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া, পশুপাখির জন্য জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ভর্তুকি বাড়ানো, সংরক্ষণাগার বাড়ানো, কৃষি উপকরণ সরবরাহ, শস্যবিমা চালু করা ও পতিত জলাশয়ে মাছ চাষ করা ইত্যাদি।
খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করা কঠিন কাজ, কারও একার পক্ষে সম্ভব না। কৃষক, শ্রমিক, কৃষিবিদ, কৃষিবিজ্ঞানী, কৃষি বিশেষজ্ঞ, কৃষিকর্মী, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একত্রে কৃষি সমবায় গঠন করে কাজ করলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজ হবে। দেশে প্রায় ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর ২ থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ (৩ দশমিক ৫ লাখ টন) খাদ্যশস্যের চাহিদা বাড়ছে। বর্তমানে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ৩ কোটি ৬২ লাখ টন চাল প্রয়োজন।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, চালের পরেই গম আমাদের খাদ্য তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ। দেশের পরিবেশ গম উৎপাদনে খুব একটা উপযোগী নয়। ফলে চাহিদা মেটাতে গম আমদানিই একমাত্র ভরসা। গম বেশি উৎপাদন হয় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ১২টি দেশে। তবে তা আনা কঠিন। তবে আমদানিরও চেষ্টা চলছে। দেশে প্রায় ৫৮ থেকে ৫৯ লাখ মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপাদন করা হয়েছে। এটার খাদ্যমূল্য আরও বেশি।
সরকার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে ও কৃষির সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর জন্য সুষ্ঠু কৃষিঋণ ব্যবস্থাপনা খুবই জরুরি বলে মনে করে সরকার। অনেক তরুণ উদ্যোক্তা বাণিজ্যিক কৃষিতে এগিয়ে আসছেন, তাদের জন্য ঋণ দরকার বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। অনেক সময় কৃষকেরা এনজিও বা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে চড়া সুদে ঋণ গ্রহণ করে। এতে কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। সেজন্য কৃষকদের সহজ শর্তে, কম সুদে, জামানত ছাড়া বিনা হয়রানিতে ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে সব বাণিজ্যিক ব্যাংক এ সংক্রান্ত কর্মসূচি চালু করেছে।
এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কৃষি যান্ত্রিকীকরণে বর্তমান সরকার ৫০ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশ ভর্তুকি দিচ্ছে। তারপরও একটা কম্বাইন হারভেস্টার কিনতে কৃষককে স্থানভেদে ১০ থেকে ১৪ লাখ টাকা দিতে হয়। ভর্তুকি দেওয়ার পরও অনেক কৃষক এত টাকা দিয়ে হারভেস্টার কিনতে পারে না। এখানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসার জন্য সরকার আহ্বান জানিয়েছে। এ জন্য কৃষকদের ঋণ দেওয়ারও অনুরোধ জানিয়েছে। সরকার মনে করে, এসব সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে দেশে ফসলের উৎপাদন বাড়বে। এতে খাদ্য মজুত শক্তিশালী অবস্থানে দাঁড়াবে বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ জন্য ব্যাংক ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের একসঙ্গে বসে, সমন্বয় করে মাঠ পর্যায়ে কৃষিঋণ বিতরণের সমস্যা সমাধানের জন্য ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে সবার জন্য পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ইতোমধ্যে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারের উৎপাদন ও প্রাপ্যতা বেড়েছে। তবে অনেক মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কম, তারা সীমিত আয় দিয়ে এখন পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার কিনতে পারে না। এক্ষেত্রে মানুষের আয় বাড়াতে হবে, এগ্রো প্রসেসিংয়ে বিনিয়োগ করতে হবে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হবে। সে লক্ষ্যেই সরকার কাজ করছে বলেও জানিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
এদিকে বৈশ্বিক খাদ্য সংকট মোকাবিলায় পর্যাপ্ত ধান উৎপাদনের পরেও যেকোনও ঝুঁকি এড়াতে সরকার চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। জানা গেছে, কৃষকদের উৎসাহমূল্য দেওয়ার লক্ষ্যে এরইমধ্যে ১১ লাখ ২১ হাজার ৯১০ মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল, ৫৫ হাজার ২০৮ মেট্রিক টন আতপ চাল এবং ২ লাখ ৬৮ হাজার ২৪৮ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করা হয়েছে এবং চলতি আমন মৌসুমে ৩ লাখ মেট্রিক টন ধান এবং ৫ লাখ মেট্রিক টন সেদ্ধ চাল কেনা এবং জিটুজি ভিত্তিতে ৫ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানির কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
চলতি অর্থবছরে পাবলিক ফুড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম খাত সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে প্রায় ২৩ লাখ ৮৭ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন চাল এবং ৭ লাখ ৪ হাজার ৩২৯ মেট্রিক টন গমসহ মোট ৩০ লাখ ৯১ হাজার ২৮৯ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য প্রয়োজন হবে। বর্তমানে সরকারি সংরক্ষণাগারে ১৩ লাখ ২১ হাজার ৪১২ মেট্রিক টন চাল, ১ হাজার ৭৭১ মেট্রিক টন ধান এবং ৩ লাখ ২৯ হাজার ৫৪৮ মেট্রিক টন গমসহ মোট ১৬ লাখ ৫২ হাজার ১১১ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুত আছে। সরকারি বিতরণ ব্যবস্থা সচল রাখাসহ নিরাপত্তা মজুত সুসংহত করার স্বার্থে এবং চালের বাজারমূল্য ভোক্তা সাধারণের জন্য সহনীয় ও স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে এ অর্থবছরে জরুরি ভিত্তিতে চাল আমদানি করা প্রয়োজন বলে মনে করে সরকার।
খাদ্য নিরাপত্তা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষির সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর জন্য সুষ্ঠু কৃষিঋণ ব্যবস্থাপনা খুবই জরুরি। ব্যাংক ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের একসঙ্গে বসে, সমন্বয় করে মাঠ পর্যায়ে কৃষিঋণ বিতরণের সমস্যা সমাধানের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মানুষের আয় বাড়াতে হবে, এগ্রো প্রসেসিংয়ে বিনিয়োগ করতে হবে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হবে। সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।