কৃষিখবর ডেস্ক : নীলফামারী সদরের ক্ষুদ্র কৃষক সাদ্দাম আলী ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে আগ্রহী নন। কারণ তার ২০ হাজার টাকা ঋণ দরকার, কিন্তু ব্যাংক এত ছোট অংকের ঋণ দিতে চায় না; আবার অনেক কাগজপত্র চায়। কিন্তু নাছোড়বান্দা হলে এই ঋণের জন্য দালাল ধরতে হয়। তার জন্য আবার ২ থেকে ৩ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
সাদ্দামের মতো লাখ লাখ ক্ষুদ্র চাষি কৃষিকে জিইয়ে রেখে দেশের মানুষের খাদ্যের জোগান দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কৃষক বাঁচাতে সবচেয়ে কম সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার যে সুযোগ সরকার দিয়েছে, তা থেকে তারা বঞ্চিত। বড় কৃষক ও ব্যবসায়ীরাই সেখান থেকে লাভবান হচ্ছেন।
বাগেরহাট চিংড়ি চাষী সমিতির সভাপতি ফকির মহিতুল ইসলাম বলেন, যাদের ৫০ হাজার বা এক লাখ টাকার ঋণ দরকার, তারা তা টাকা পান না। কিন্তু বাগেরহাটে বেশিরভাগই ছোট বর্গা চাষি, যাদের ছোট ঋণ দরকার।
কৃষি ঋণে পেতে ঘুষ দাবি ও লাল ফিতার দৌরাত্ম্য চলছে বলে অভিযোগ করেন বাগেরহাটের কচুয়ার চাষি মিঠু চক্রবর্তী। তিনি বলেন, “যুব উন্নয়ন থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর আমাকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ দিতে চেয়েছিল। এজন্য ৫ হাজার টাকা ঘুষ চাওয়া হয়েছিল। আমি সেই টাকা নিইনি।”
বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষি খাতকে প্রাধান্য দিয়ে অন্যান্য ঋণের চেয়ে কৃষি ঋণে সুদের হার ১ শতাংশ কম রাখার নির্দেশ দিয়েছে। ফলে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া অন্য যে কোনো ঋণে সুদের হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ হওয়ায় কৃষি ঋণে সুদের হার ৮ শতাংশ ধরা হয়েছে।
তবে বেসরকারি ব্যাংকগুলো চাইলে মোট কৃষি ঋণের ৭০ শতাংশ অন্যান্য চ্যানেলের মাধ্যমে বিতরণ করতে পারে। এই সুযোগ নিয়ে ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার মাধ্যমে কৃষিঋণ বিতরণ করছে।
আর তার মাশুল গুণতে হচ্ছে ক্ষুদ্র চাষিদের। কারণ ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলো সরকারের বেঁধে দেওয়া সুদহারের তিন গুণের বেশি পর্যন্ত সুদও নিচ্ছে। কিন্তু নিরুপায় ক্ষুদ্র কৃষক টাকার জন্য তাদের কাছেই যাচ্ছে।
নেত্রকোনার কলমাকান্দার কনুরা গ্রামের কৃষক মন্টু চন্দ্র বলেন, “ব্যাংক কম টাকা ঋণ দেয় না। আমরা ব্যাংকে যাই না। আমাদের টাকা দরকার হলে আমরা এনজিও থেকে ঋণ নিই।”
নীলফামারী সদরের ইটাখোলার চাষি দুলু মিয়া বলেন, “বড় কৃষকরা ঋণ ব্যাংক থেকে পায়, আমরা পাই না। আমাদের টাকা দরকার হলে আমরা আশা, ব্র্যাকের মতো এনজিও থেকে ঋণ নিই।”
কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল নীতিমালা ও দায়সারা নিরীক্ষার কারণে ক্ষুদ্র চাষিদের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ হারে সুদ দিতে হচ্ছে, যেখানে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশে মোট ৫ হাজার ২১০ কোটি ৫০ লাখ টাকার কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি। আর ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ব্যাংকগুলো দেশে মোট ২৫ হাজার ৫১১ কোটি টাকার কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণ করেছে, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৯৭ দশমিক শূণ্য ৩ শতাংশ।
এই ঋণ বিতরণ তার আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে ২ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা বা ১২ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি।
কৃষি ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, গত বছর বেশ কিছু ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণ দিতে পারেনি। সেগুলো শাস্তি এড়াতে কৃষি ঋণ বিতরণ বাড়িয়ে দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। পাশাপাশি এবার কৃষি ঋণ বাড়াতে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোর উপর বিশেষভাবে নির্ভর করা হয়েছিল বলেও জানান এই ব্যাংকার।
কৃষি ঋণ বিতরণ বাড়লেও স্বল্প সুদে সরাসরি ব্যাংক থেকে তা নেওয়ার সুবিধা যে ক্ষুদ্র চাষিরা পান না তা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক এই নেতার কথায় স্পষ্ট।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪০টি বেসরকারি ব্যাংক ১১ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা কৃষি ঋণ বিতরণ করেছে, যার ৬৩ শতাংশ ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে।
সরকারি ব্যাংকগুলো কৃষি ঋণের বেশিরভাগ অংশ নিজস্ব চ্যানেলের মাধ্যমে বিতরণ করলেও বেসরকারি ব্যাংক তা করে না। বেশ কিছু বেসরকারি ব্যাংক ন্যূনতম ৩০ শতাংশ কৃষি ঋণ নিজস্ব চ্যানেলের মাধ্যমে বিতরণ করার নির্দেশনাও অনুসরণ করে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
তবে প্রান্তিক কৃষকরা ব্যাংক থেকে কৃষি ঋণ না পাওয়ার যে অভিযোগ করেছেন, তা মানতে নারাজ এবিবির সভাপতি ও ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সভাপতি আলী রেজা ইফতেখার। তিনি বলেন, “প্রান্তিক কৃষকরা ব্যাংক থেকে পান। তবে যে সব ব্যাংকের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শাখা নেই, তারা ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করেন।”
একই সুরে কথা বলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, “প্রান্তিক কৃষকরা ব্যাংক থেকে টাকা পান। তবে যেখানে ব্যাংকের শাখা নেই, সেখানে মাইক্রোক্রেডিটের মাধ্যমে টাকা দেওয়া হয়। মাইক্রোক্রেডিটের সুদের হার একটু বেশি হয়। আমরা লক্ষ্য রাখি কৃষকরা যেন কম সুদে টাকা পায়।”