Ultimate magazine theme for WordPress.

‘গোল্ডেন রাইস’ চাষের অনুমতি দিচ্ছে বাংলাদেশ!

0

কৃষিখবর ডেস্ক : বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড (জিএম) পদ্ধতির ধান ‘গোল্ডেন রাইস’ চাষের অনুমোদন দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। উদ্ভাবকদের দাবি, উন্নয়নশীল বিশ্বের শিশুদের অন্ধত্ব ও মৃত্যু ঠেকাতে জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয়েছে এই জাতের ধান। তবে এই জাতের ধান চাষ উন্নয়নশীল বিশ্বে স্বাস্থ্যগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ। কৃষক সংগঠনের বিরোধিতার পরও ধানটির চাষ জনপ্রিয় করতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থাকে সহযোগিতা করছে বিল অ্যান্ড মেলিন্দা গেটস ফাউন্ডেশন। ২০ নভেম্বর অ্যামেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স কর্তৃক প্রকাশিত সায়েন্স ম্যাগ জার্নালের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।

সায়েন্স ম্যাগ জার্নালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ২০ বছর আগে প্রথম সংবাদ শিরোনাম হয় গোল্ডেন রাইস। দীর্ঘ সময় ধরে জিএম শস্যটি নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক হয়েছে। এই ধানের সমর্থকদের দাবি, মানবতার সম্ভাব্য উপকারের উদাহরণ হতে পারে এটি। তবে সমালোচকদের যুক্তি হলো, উন্নয়নশীল বিশ্বের স্বাস্থ্য উন্নয়নে এটি ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ।

১৯৯০ দশকের শেষ দিকে ‘গোল্ডেন রাইস’র উন্নয়ন ঘটান জার্মান উদ্ভিদবিজ্ঞানী ইনগো পোটরিকাস ও পিটার বেয়ার। ভিটামিন-এ’র অভাব মোকাবিলায় এই উদ্যোগ নেন তারা। ভিটামিন-এ শিশুদের অন্ধত্বের অন্যতম কারণ। এছাড়া এর স্বল্পতায় হামের মতো সংক্রামক রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়। শাক, মিষ্টি আলু ও অন্যান্য সবজিতে যথেষ্ট পরিমাণে এই ভিটামিন থাকলেও বেশকিছু দেশে এখনও এর অভাব রয়েছে। বিশেষ করে যেসব দেশের প্রধান খাদ্য ভাত, সেসব দেশে এই ভিটামিনের ঘাটতি লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশেরও ২১ শতাংশ শিশু ভিটামিন-এ’র অভাবে আক্রান্ত।

ফিলিপাইনের লস ব্যানোসের আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইআরআরআই) উদ্ভাবন করে গোল্ডেন রাইস। বর্তমানে তা বাংলাদেশের পর্যবেক্ষণে রয়েছে। গবেষকরা ধান-২৯ নামে প্রচলিত একটি জাতে এর বেটা-ক্যারোটিন জিন সংযোজন করেছেন। বাংলাদেশে শুষ্ক মৌসুমে এই জাতের ধানের ব্যাপক চাষ হয়। জাতীয় ফলনের প্রায় ১৪ শতাংশ আসে ওই জাতটি থেকে। গাজীপুরের বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআরআরআই) গবেষকরা একাধিক স্থানে ধান-২৯ গোল্ডেন রাইসের পরীক্ষামূলক চাষ চালিয়েছে। এসব পরীক্ষায় এই ধান চাষে নতুন কোনও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়নি। এমনকি ভিটামিন-এ’র উপস্থিতি ছাড়া গুণগত মানেও বড় কোনও পরিবর্তন হয়নি।

২০১৭ সালের নভেম্বরে গোল্ডেন রাইস সংক্রান্ত তথ্য বাংলাদেশের বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে পাঠায় বিআরআরআই। মন্ত্রণালয়ের জৈব-নিরাপত্তা সংক্রান্ত একটি কোর কমিটি ফসলটির পরিবেশগত ঝুঁকি পর্যালোচনা করছে। এই কমিটিতে বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে আটজন সদস্য রয়েছেন। এতে ফসলটি আগাছায় রূপান্তরিত হওয়ার আশঙ্কা আছে কিনা তা খতিয়ে দেখার পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। ওই পর্যালোচনা প্রায় শেষ। গত ২৮ অক্টোবর বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ঢাকা ট্রিবিউনের খবরে বলা হয়, ১৫ নভেম্বর এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

তবে জৈবনিরাপত্তা সংক্রান্ত কোর কমিটির এক সদস্যের মৃত্যুর কারণে নির্দিষ্ট ওই তারিখ পার হয়ে গেলেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। কমিটির আলোচনার বিষয়ে ওয়াকিবহাল একটি সূত্র জানিয়েছে, কয়েক জন সদস্য গোল্ডেন রাইস নিয়ে এখনও সন্দেহপ্রবণ। মানুষ যখন আরও বেশি শাকসবজি খেতে পারে তখন এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন তারা।

তবে এর প্রবক্তারা এখনও আশাবাদী। তারা বলছেন, এর পক্ষে জোরালো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ রয়েছে। এর আগেও জৈব-নিরাপত্তা কমিটি আরেকটি জিনগত পরিবর্তিত শস্য অনুমোদন করেছে আর গোল্ডেন রাইসের বিষয়ে বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক সমর্থন রয়েছে।

বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট যুক্তরাজ্যের রথহ্যামস্টেড রিসার্চের উদ্ভিদ জৈব-প্রযুক্তিবিদ জোনাথান নেপিয়ার সম্প্রতি সায়েন্স ম্যাগ’কে বলেছেন, ‘এটি সত্যিই খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা গোল্ডেন রাইস চাষের অনুমতি প্রায় চূড়ান্ত করার কথা বলতে পারছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনুমোদন পেলে প্রমাণ হবে, জনস্বার্থে সরকারি অর্থে পরিচালিত গবেষণাকেন্দ্র সফলভাবে কৃষি জীবপ্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটাতে পারে। ২০২১ সালের আগে প্রথমবারের মতো এই ফসল চাষের আশা করা হচ্ছে না। এছাড়া গোল্ডেন রাইস থেকে বাস্তবিক উপকারের প্রমাণ দেখাতে আরও গবেষণা দরকার পড়বে।’

জোনাথন বলেন, ‘এই ধান চাষের অনুমোদন পেতে দেখতে পাওয়া অসাধারণ বিষয় হবে। দীর্ঘদিনের প্রত্যাশার পর এটি অনুমোদন পেতে যাচ্ছে।’

ফার্মিং ফিউচার বাংলাদেশের পরিচালক আরিফ হুসেইন বলেন, ‘শিগগিরই গোল্ডেন রাইস সবুজ সংকেত পাবে বলে আমরা আশাবাদী।’ এই প্রতিষ্ঠানটি বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে জৈবপ্রযুক্তি সম্পর্কে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক ও অন্যদের অবহিত করে থাকে।

পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর গোল্ডেন রাইসকে অবশ্যই কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ অনুমোদনকারী সংস্থার নিবন্ধন নিতে হবে। এজন্য বীজের মান যাচাইয়ে একাধিক স্থানে পরীক্ষা করা হবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২১ সাল নাগাদ গোল্ডেন রাইস আবাদ করতে পারবে কৃষকেরা।

তবে এই ফসলটি কতোটা জনপ্রিয় হবে, তা অনিশ্চিত। নেদারল্যান্ডসের ওয়েজেনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিবিষয়ক কলামিস্ট জাস্টাস ওয়েসেলার বলেন, ২০১৪ সালে জিএম পদ্ধতির একটি বেগুনের প্রচলন হলে বাংলাদেশের কৃষকরা তা দ্রুত লুফে নেয়। ওই ফসলে কৃষকদের তাৎক্ষণিক একটি লাভ ছিল: এতে কীটনাশকের প্রয়োজনীয়তা কমে যায়। তবে গোল্ডেন রাইসের স্বাস্থ্যগত সুফল পাওয়া যাবে খুব ধীরে। ফলে কৃষকরা এটি খুব ধীরে গ্রহণ করতে পারে। আরিফ হুসেইন মনে করেন, এটি জনপ্রিয় করতে সরকারি উদ্যোগের প্রয়োজন হবে, এমনকি এই ধান চাষে কৃষকদের ভর্তুকি দেওয়া লাগতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের মেডিসনের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিটামিন-এ ও বৈশ্বিক স্বাস্থ্য বিষয়ে অধ্যয়নকারী শেরি তানুমিহারজো বলেন, চালের রঙ সোনালি হওয়া ভোক্তা পর্যায়ে এই ধানের গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা। মানুষ যে খাবার খায়, সেটির রঙ পরিবর্তনের সময় কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। আর বাংলাদেশের বহু মানুষ সাদা ভাত খেতেই পছন্দ করে। অন্যদিকে রান্না করা গোল্ডেন রাইস দেখতে অনেকটা খিচুড়ির মতো হবে। হয়তো এ কারণে এর গ্রহণযোগ্যতা কিছুটা বাড়তে পারে।

বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও অপুষ্টির হার বেশি, এমন শহর ও গ্রামাঞ্চলে এই ফসল চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার কৌশল প্রণয়নে কাজ করছে আইআরআরআই ও বিআরআরআই। এতে সহায়তা দিচ্ছে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন।

বেসরকারি সংগঠন ও এনজিও বিরোধিতায় এই ফসল প্রচলনের বাধা হতে পারে। গত মাসে বাংলাদেশের দুটি কৃষক সংগঠন গোল্ডেন রাইস ও জিএম পদ্ধতির বেগুন নিষিদ্ধের আহ্বান জানিয়েছে। গ্রুপ দুটি হলো কৃষক শ্রমিক ফেডারেশন এবং জাতীয় নারী কৃষক ও শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশন।

বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক জায়েদ ইকবাল খান বলেন, বহুজাতিক কোম্পানির উদ্ভাবিত গোল্ডেন রাইসে অতিমাত্রায় সংক্রমণ ঘটে, যা আশেপাশের জমিতে ছড়িয়ে যায়। শুধু তাই নয়, এটি পানি, মাটি ও বায়ুর মাধ্যমে ক্রস পলিনেশন অথবা এক প্রজাতির পরাগ রেণু, আরেক প্রজাতির পরাগকে নিষিক্তকরণ ক‌রে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে গোল্ডেন রাইস চালু হলে কৃষি ও কৃষকের চরম ক্ষতি হবে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে জিএম বেগুন চাষ করে কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। অনেক কৃষক সেখানে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। সেখানে প্রায় ২৫ লাখ কৃষক আত্মহত্যা করেছে। এ ধান বাংলাদেশে চাষ করা হলে কৃষকের নিজস্ব বীজ সংরক্ষণ ও উৎপাদন প্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে ব্যাহত হবে।
//এআরএইচ//

Leave A Reply

Your email address will not be published.