চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি : জার্মপ্লাজম সেন্টারে ঝুলে আছে অ্যাভোকাডো ফলআমের রাজ্য চাঁপাইনাববগঞ্জে স্ট্রবেরি, ড্রাগন, মিষ্টি মাল্টা, কমলা, লটকন, সিডলেস পেয়ারা ও কাশ্মিরি কুলের পর এবার উৎপাদন তালিকায় যোগ হয়েছে বিদেশি ফল ‘অ্যাভোকাডো’। পৃথিবীর পুষ্টিকর ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম এই ফলের আছে ওষুধি গুণও। বাজারে ভালো দাম ও চাহিদা থাকায় এই ফলের বাণিজ্যিক উৎপাদনে ঝুঁকছেন চাষিরা। হর্টিকালচার সেন্টার ও কৃষি বিভাগের সহায়তায় শুরু হয়েছে বাগান তৈরির কাজও।
ফল গবেষকরা বলছেন, আমেরিকা থেকে আসা এই ফলটি স্বাদে ও পুষ্টিগুণে অনন্য। এর চাষ পদ্ধতিও সহজ। বাজারে ভালো চাহিদা থাকায় আমদানি নির্ভর এই ফল চাষের প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন কৃষকরা। ফলের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা নিয়েও আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা। স্থানীয় কৃষি অফিস জানিয়েছে, অ্যাভোকাডো ফলের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণে এরই মধ্যে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের জার্মপ্লাজম অফিসার কৃষিবিদ জহুরুল ইসলাম জানান, ‘১২ বছর আগে আমেরিকা থেকে এই ফলের বীজ এনে চারা উৎপাদন করে, হর্টিকালচার সেন্টারের জার্মপ্লাজম সেন্টারে রোপণ করা হয়। এরপর শুরু হয় অভিযোজন গবেষণা। ছয় বছর পর আসে প্রথম সাফল্য। এরপর গত চার বছর ধরে নিয়মিত ফল আসায়, ২০১৭ সাল থেকে কলম চারা তৈরির মাধ্যমে শুরু হয় বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাজার মূল্য উচ্চ এবং চাহিদা ভালো থাকায় এই ফল চাষ, কৃষকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে।’
হর্টিকালচার সেন্টারের গবেষকরা বলছেন অ্যাভোকাডো চাষে খরচ অল্প; কিন্তু লাভ অনেক বেশি। আর আবহাওয়া ও মাটির গুনাগুণ অনূকুলে থাকায় চাঁপাইনবাবগঞ্জে এই ফল চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
গবেষণা কেন্দ্রের উদ্যানতত্ত্ববিদ ও উপ-পরিচালক সাইফুর রহমান জানান, এ ফলের আকার পেয়ারা বা নাশপাতির মতো। একেকটা ফলের ওজন প্রায় ৫০০ থেকে ৭০০ গ্রাম। ফলের ভেতরে বেশ বড় ডিম্বাকার বীজ থাকে। বিচিটি আস্ত রেখে ফালি করে কেটে খোসা ছাড়িয়ে খেতে হয়। আহার্য্য অংশ মাখনের মত মোলায়েম; হালকা মিষ্টি স্বাদের। পেঁপের মত কাঁচা-পাকা এই ফল সবজি, ভর্তা, সালাদ, শরবতসহ বিভিন্নভাবে খাওয়ার সুবিধা আছে।
সাধারণত জুলাই মাসের পর থেকে দেশের বাজারে, ভালো মানের ফলের প্রাপ্যতা যখন কমে আসে, তখন বাজারে আসে এই ফল। স্বাদে ও পুষ্টিগুণে অনন্য এই ফল চাষ করে বাণিজ্যিকভাবে সফল হবেন চাষিরা, এমনটাই প্রত্যাশা ফল গবেষকদের। পাশাপাশি পুষ্টির চাহিদা পূরণেও; বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে এই ফল।
সরজমিনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের জার্মপ্লাজম সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, মাতৃগাছে থোকায় থোকায় ধরে আছে অ্যাভোকাডো। মাতৃগাছের চারপাশে দেখা গেছে আরও ১৫ থেকে ২০টি অ্যাভোকাডোর গাছ। যেগুলোর বয়স মাস ছয়েকের মতো। কলম চারার মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে এসব গাছ।
জার্মপ্লাজম সেন্টারে থোকায় থোকায় ঝুলে থাকা অ্যাভোকাডোঅ্যাভোকাডোর পুষ্টিগুণ বিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের উপ-পরিচালক সাইফুর রহমান জানান, এই ফল পুষ্টিতে ভরপুর এবং ওষুধিগুণে সমৃদ্ধ। অ্যাভোকাডো দেহকে সোডিয়াম, সুগার ও কোলেস্টোরেল মুক্ত রাখে। এই ফলে ক্যালোরি অনেক বেশি। এটি হার্টকে সুস্থ রাখে ও ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। চর্বি গলে যায় এমন পুষ্টি উপাদানও রয়েছে এ ফলে। শিশুদের সুস্থতা ও বৃদ্ধির জন্য এই ফল আহারের গুরুত্ব অপরিসীম। এ ফল মায়ের দুধের বিকল্প হিসেবে সুপরিচিত। অ্যাভোকাডোতে দেহের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের ভিটামিন ও মিনারেল রয়েছে; বিশেষ করে ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক, কপার ও ম্যাঙ্গানিজের উপস্থিতি এতে বেশি। প্রচুর ভিটামিন সি, বি-৬, রিভোফ্লাবিন ছাড়াও এই ফলে রয়েছে দেহের জন্য প্রয়োজনীয় ফাইবার। বয়স্কদের মাসল ও হাড় ক্ষয় রোধে এবং মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গের ক্যান্সার রোধক হিসেবে এ ফল কাজ করে। শুধু তাই নয় মানসিক চাপ, হতাশা দূরীকরণ, ক্ষুধা বৃদ্ধি, সুনিদ্রা নিশ্চিত করা এবং দেহের ক্ষতিকর দ্রব্যাদি প্রস্রাব ও মল আকারে বের হয়ে দেহকে সুস্থ রাখতে এ ফল সহায়তা করে।
তিনি আরও জানান, সাধারণত ৪ থেকে ৬ বছরের মধ্যে এই গাছে ফল ধরা শুরু করে। গাছের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফল আসার পরিমাণও বাড়তে থাকে। ফল পাকে আগস্টের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে। ঢাকার কোনও কোনও ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কেজিপ্রতি ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকায় এই ফল বিক্রি হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মঞ্জুরুল হুদ জানান, ‘অ্যাভোকাডো দারুণ একটি ফল। আমাদের দেশে এই ফল অতি উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়। আমদানি নির্ভর এই ফলের চাহিদাও ব্যাপক। আমরা আশা করছি এই ফল যখন এই জেলায় বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হবে; এতে মানুষ যেমন উন্নত ফল ও পুষ্টি পাবে; তেমনি কৃষকরা এই ফল চাষাবাদের মাধ্যম্যে নতুন দিগন্ত খুঁজে পাবেন। এই ফলের বিষয়ে আমরা অত্যন্ত আশাবাদী।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অ্যাভোকাডো আমদানি নির্ভর ফল। দেশে বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ সম্প্রসারণ করা গেলে একদিকে যেমন কমবে আমদানি নির্ভরতা; তেমনি চাষিরা পাবে উচ্চ মূল্য।
//এআরএইচ//