Ultimate magazine theme for WordPress.

কৃষকের ধানের দাম কৃষকের হাতেই দিন

0

* আতিকুর রহমান হাবিব *
সরকার প্রতি কেজি বোরো ধানের মূল্য নির্ধারণ করেছে ২৬ টাকা। সে হিসেবে এক মন ধানের দাম ১০৪০ টাকা। বাস্তবে কৃষক এক মন ধান ৬০০ টাকাও বিক্রি করতে পারছেন না। ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ টাকায় ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। কৃষকের কাছ থেকে ৫০০ টাকায় কিনে মধ্যস্বত্বভোগী ফরিয়ারা সরকারের কাছে তা ১০৪০ টাকায় বিক্রি করছেন। এতে একদিনে কৃষক তার উৎপাদন খরচ পাচ্ছে না। অন্যদিকে মধ্যস্বত্ত¡ভোগীরা মুনাফা লুটছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে কৃষকরা ফসল উৎপাদন বন্ধ করে দেবে। খাদ্য সংকটে পড়বে দেশ। সমস্যার গুরুত্ব বিবেচনা করে কৃষকের ধানের ধান কৃষকের হাতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারের অব্যবস্থাপনার কারণে কৃষক তার উৎপাদন খরচও পাচ্ছে না। এ নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই কৃষকরা প্রতিবাদ করছেন। প্রতিকার চাইছেন। কিন্তু পাচ্ছেন না। এ পরিস্থিতিতে অভিনব প্রতিবাদ করেছেন টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার পাইকড়া গ্রামের কৃষক আবদুল মালেক সিকদার। একদিকে ধানের ন্যায্য মূল্য নেই অন্যদিকে শ্রমিকের চরম অভাব। উৎপাদন খরচ বাদ দিলেও শুধু ধান কাটার খরচও বর্তমান বাজার দরে মিলে না। সাড়ে ৮০০ টাকার দিনমজুর দিয়ে ধান কেটে তা ৫০০ টাকা মনে বিক্রি করতে হয়। এ পরিস্থিতিতে রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে গত ১২ মে নিজের পাকা ধান ক্ষেতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। এ বিষয়ে আব্দুল মালেক বলেন, প্রতিমণ ধানের দাম থেকে প্রতি শ্রমিকের মজুরির দাম দ্বিগুণ। এবার ধান আবাদ করে আমরা মাঠেমারা পড়েছি। তাই মনের দুঃখে পাকা ধানে আগুন দিয়েছি।
কৃষকের লাভ নিশ্চিত করে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটি ধান ও চালের মূল্য নির্ধারণ করে। এক্ষেত্রে শ্রমের মজুরি (পারিবারিক ও ভাড়াকৃত শ্রম), বীজ, জৈবসার, জমি কর্ষণ বাবদ খরচ, সেচ ও ধান থেকে চাল করার মিলিং খরচ (সিদ্ধ ও পরিবহনসহ), তুষ বা কুড়ার মূল্য বিবেচনায় নেয়া হয়। উৎপাদন ব্যয় নির্ধারণ সভায় কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন সংস্থা, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, খাদ্য অধিদপ্তর, খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের মতামতের ভিত্তিকে এবারো একই নিয়মে উৎপাদন ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে।
ঘোষণা অনুযায়ী, চলতি বোরো মৌসুমে ১৩ লাখ ৫০ হাজার টন চাল, ধান ও গম সংগ্রহ করবে খাদ্য মন্ত্রণালয়। গত ২৫ এপ্রিল থেকে সরকার ধান ও চাল সংগ্রহ শুরু করেছে। চলবে আগস্ট পর্যন্ত। কিন্তু সরকার কার কাছ থেকে কিভাবে ধান ও চাল সংগ্রহ করছে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী প্রতিমন ধানের দাম ১০৪০ টাকা। অথচ দেশের কোথাও কোনো কৃষকই সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধান বিক্রি করতে পারেননি। তারা প্রতিমন ধান বিক্রি করছেন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়। এর ফলে চাষীরা ধানের উৎপাদন খরচও ঘরে তুলতে পারছেন না। ধান চাষ করে লোকসান গুণে হতাশ চাষীদের সামনে অন্ধকার। আগামীতে তারা কৃষিকাজ করবেন কি না? না করলে তাদের সামনে বিকল্প কি রয়েছে? এসব নিয়ে ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছেন না। এ পরিস্থিতিতে রাগে, ক্ষোভে অনেক চাষী প্রতিবাদী হয়ে উঠছেন। কেউ পাকা ধানের ক্ষেতে নিজেই আগুন লাগিয়ে দিচ্ছেন। কেউবা রাস্তায় ধান ফেলে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
কৃষকের এই করুন প্রতিবাদকেও আমাদের নীতিÑনির্ধারকরা আমলে নিচ্ছেন না। তারা এখানেও নোংরা রাজনীতির গন্ধ খোঁজছেন। দুয়েকজন মন্ত্রী ইতিমধ্যে গন্ধ পেয়ৌ গেছেন। তারা কৃষকের এই করুন অবস্থার বহিঃপ্রকাশকে বলছেন ‘সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র’। কেউ বলছেন ‘ভাবাবেগ’। কৃষকের প্রকৃত সমস্যা সমাধানের পথে কেউ এগোচ্ছেন না।
সরকার যে ধান হাজার টাকা মনে কিনছে সেই ধান কৃষক কেন ৫০০ টাকায় বিক্রি করবে? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন না কেউ। বাস্তবতা হচ্ছে সরকার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কবজায় চলে গেছে। নানা অৎুহাতে সরকার কৃষকের ধান কৃষকের কাছ থেকে কিনছে না। অভিযোগ রয়েছে মিল মালিক সমিতি এবং স্থানীয় ধান ব্যবসায়ী ফরিয়াদের কাছ থেকে ধান কেনার জন্য সরকার চুক্তিও করেছে। এটিকে কৃষক মারার চুক্তিও বলছেন অনেকে।
তবে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এখনো এ দিকে নজর দিচ্ছেন না। বিষয়টি তারা আমলেও নিচ্ছেন না। তাদের যুক্তি- ধান রাখার সরকারি গুদামে জায়গা নেই। এ মুহূর্তে ধান কিনে দাম বাড়ানোর সুযোগ সরকারের হাতে নেই। মিল মালিকরাও আমন চাল বিক্রি করতে পারেননি বলে নতুন করে বোরো ধান কিনছেন না। এ পরিস্থিতিতে সরকার ধান ও চাল রপ্তানির চিন্তা ভাবনা করছে।
কৃষকরা কিন্তু সরকারকে ধানের দাম বাড়াতে বলেনি। শুধু সরকার ঘোষিত মূল্য কৃষকের হাতে পৌঁছে দেয়ার দাবি জানিয়েছে। অবশ্য দাবিটাও জানাতে পারেনি। কার মাধ্যমে, কিভাবে দাবি জানাবে? রাজনীতিবিদরাতো আর খেটে খাওয়া সাধারণ কৃষকের কথা শোনেন না। সরকারও কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনে না। কৃষক পর্যায়ে ধান ক্রয়ের কোনো প্রচারণা নেই। নেই ব্যবস্থা। বিপুল পরিমাণ ধান ক্রয়ের সরকারি ক্রয়কেন্দ্র না থাকায় কৃষক তার কষ্টের-স্বপ্নের বোরো ধান সরকারের কাছে বিক্রি করতে পারছে না। ধান-চালের বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নিয়ন্ত্রণ দিয়ে দিয়েছে মধ্যস্বত্ত¡বভোগী আর চাল আমদানিকারক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটদের হাতে। এ কারনে কৃষকের লাভের টাকা চলে যাচ্ছে মিলমালিক এবং ফরিয়াদের পকেটে।
এবার কৃষক পাকা ধানে আগুন দিয়েছে। সামনে কৃষক ফসল উৎপাদন বন্ধ করে দেবে। এ পরিস্থিতিতে পতিত জমির পরিমাণ বাড়বে। মোট আবাদ যোগ্য ৮৫,০৫,২৭৮ দশমিক ১৪ হেক্টর জমির মধ্যে আবাদযোগ্য পতিত জমির পরিমান ২০৪৩৬৬ দশমিক ২৪ হেক্টর। কৃষকের ফসলের লাভজনক দাম নিশ্চিত করতে না পারলে আবাদ যোগ্য পতিত জমির পরিমাণ আরো দ্রæত গতিতে বাড়বে। এক পর্যায়ে খাদ্য সংকটে পড়বে দেশ। এখনো সময় আছে কৃষকের কষ্টে ফলানো ধানের দাম কৃষকের হাতে তুলে দিন। কোনো দালাল, বেনিয়া কিংবা মধ্যস্বত্ত¡ভোগীর হাতে নয়। কৃষক বাঁচান, আপনি বাঁচবেন। বাঁচবে দেশ।

* সাংবাদিক, কলাম লেখক।

//এআরএইচ//

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.