দিনাজপুর প্রতিনিধি : সরকারি নির্দেশনা ও আদালতের আদেশ অমান্য করে দিনাজপুরের অধিকাংশ হিমাগারগুলোতে ৫০ কেজির বেশি ওজনের আলুর বস্তা রাখা হচ্ছে। বেশি ওজনের বস্তা উঠানামা করতে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে শ্রমিকদের। এসব তদারকির দায়িত্বে থাকা শ্রমবিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন হিমাগার পরিদর্শনে গিয়ে ত্রুটি দেখা গেছে। ত্রুটিপূর্ণ হিমাগারগুলোকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর ৭৪ ধারা এবং বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫’র ৬৩ বিধি মোতাবেক শ্রমিকদের ৫০ কেজির বেশি ওজন বহন করা সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ। ২০১৮ সালেও সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ৫০ কেজির অধিক ওজন বহন করানোর বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। এরই প্রেক্ষিতে দেশের সমস্ত হিমাগারগুলোতে ৫০ কেজির অধিক ওজনের বস্তা প্রবেশ করানো ও রাখার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতোর।
গত বছরের ১৫ জুলাই দেশের সকল কলকারখানা কর্মকর্তাদের একটি নির্দেশনা পত্র দেয় কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের আইন উপশাখা। যেখানে বলা হয়- পবা উপজেলা কুলি শ্রমিক ইউনিয়ন কর্তৃক মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন নং-১৭৬১/২০১৭ দায়েরের পরিপ্রেক্ষিতে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ গত ২০১৮ সালের ৫ মার্চ রায় প্রদান করেছেন। রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০-৬ এর ৭৪ ধারা অনুযায়ী কোনও প্রতিষ্ঠানে কোনও শ্রমিকের ক্ষতি হতে পারে এমন কোনও ভারি জিনিস উত্তোলন, বহন অথবা নাড়াচাড়া করতে দেওয়া যাবে না।
দেশের হিমাগারগুলোতে কুলি-শ্রমিকদের দিয়ে ৮০-১২০ কেজি ওজনের ভারি আলুর বস্তা বহন ও পরিবহন করানো বিদ্যমান শ্রম আইন ও বিধির সুষ্পষ্ট লঙ্ঘন এবং বেআইনি। যাতে করে তাদের বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক ব্যধিসহ শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত জটিলতা, মেরুদণ্ডে আঘাত, হাঁটু ও কাঁধে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে অসুস্থ কিংবা মৃত্যুও হতে পারে। তাই এটি লঙ্ঘন হচ্ছে কি না সে ব্যাপারে অনুসন্ধান বা পরীক্ষণ পরিচালনা করা, নির্দেশ পালনে ব্যর্থ হলে আদালতে অভিযোগ দায়ের করা, প্রচার-প্রচারনা চালানোসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়।
দিনাজপুর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের অধীনে ৩টি জেলায় মোট হিমাগার রয়েছে ২৮টি। এর মধ্যে দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ে ১২টি করে ২৪টি এবং পঞ্চগড়ে ৮টি হিমাগার রয়েছে। এ বছর দিনাজপুরের ২৮টি হিমাগারকে শ্রমিক দিয়ে ৫০ কেজির অধিক ওজন বহন না করতে চিঠি দেয় দিনাজপুর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের উপ-মহাপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান।তবে বাস্তবে এই নির্দেশনার কোনও প্রতিফলন হয়নি। নিষেধাজ্ঞার পরেও দিনাজপুরের অধিকাংশ হিমাগারগুলোতে প্রবেশ করানো হচ্ছে ৫০ কেজির অধিক ওজনের বস্তা।
দিনাজপুর সদরের পূর্ণভবা হিমাগারে গিয়ে দেখা যায় সেখানে যেসব বস্তা প্রবেশ করানো হচ্ছে তার একেকটির ওজন ৮০ থেকে ৯০ কেজি। প্রথমে বিষয়টি অস্বীকার করে সেখানকার ব্যবস্থাপক রেজাউল ইসলাম। পরে অনুরোধ করা হলে তিনি কয়েকটি বস্তা মেপে দেখান। যেখানে একেকটির ওজন ৮২ কেজি থেকে ৮৭ কেজি পর্যন্ত দেখা যায়। এরপরে তিনি বলেন, ‘কিছু কৃষক না বুঝে এসব বড় বস্তা নিয়ে আসছেন। পরে তাদের জোরে এসব বস্তা রাখা হচ্ছে। তবে যেসব বড় বস্তা রাখা হচ্ছে তার পরিমাণ খুবই কম।’ এ সময় সাংবাদিকদের সামনে তিনি বড় বস্তা নিয়ে আসা কয়েকটি আলু বোঝাই ট্রাক্টর ভিতরে প্রবেশ করতে বাধা দেন।
সেখানেই কথা হয় এক ট্রাক্টর চালক আইনুল ইসলামের সাথে। তিনি জানান, কসবা এলাকা থেকে এখানে এসেছেন আলুর বস্তা নিয়ে। ৫০ কেজি ওজনের অধিক বস্তা হিমাগারে রাখা যাবে না এমনটি তিনি জানেন না। এর আগেও এক ট্রাক্টর আলু রেখেছেন, তখনও তাকে বলা হয়নি।
রামনগর এলাকার কৃষক শিপন জানান, একটি বস্তাতে যত বেশি রাখা যাবে ততই লাভ। তবে ৫০ কেজির বেশি ওজনের বস্তা রাখা যাবে না এমনটি জানা নেই। পূর্ণভবা হিমাগার থেকেও তাদেরকে এমনটি জানানো হয়নি।
কৃষক মাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরেই তো হিমাগারে আলু রাখি, এমন তো কোনও কথা উঠেনি। বেশি ওজনের বস্তা নেওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা থাকলে আমরাও চাই না বেশি ওজনের বস্তা রাখতে।’
একই অবস্থা জেলার দশমাইল এলাকায় অবস্থিত রাহবার হিমাগারেও। সেখানে যেসব বস্তা রাখা হচ্ছে সেগুলোর ওজনও ৮০ থেকে ১০০ কেজি করে। এসময় সাংবাদিকদের সামনে বড় বস্তা রাখার ক্ষোভ প্রকাশ করে সেখানে কর্মরত শ্রমিকরা। বীরগঞ্জের জগদল এলাকা থেকে এই হিমাগারে কাজ করা শ্রমিক পঙ্গেস জানান, এখানে যেসব বস্তা রয়েছে তা কমপক্ষে ৮০ থেকে ৮৫ কেজি। যা বহন করতে তার সমস্যা হচ্ছে। এরপরেও পেটের দায়ে এই ভারী বস্তা বহন করতে হচ্ছে তাদেরকে।
একই এলাকা থেকে কাজ করতে আসা শ্রমিক অতোশ চন্দ্র সরকার বলেন, ‘বস্তা ছোট করলে কাজ করতে সুবিধা হতো। এ ব্যাপারে যদি কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তাহলে দীর্ঘদিন কাজ করার সুযোগ পাবো। নাহলে বয়সের আগেই কাজ করা বাদ দিতে হবে। ছোট বস্তা রাখার অনুরোধ জানালো হলেও কর্মকর্তারা কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন না। একেকটি বস্তায় ১১০ কেজি পর্যন্ত আলু রয়েছে।’
তিনি জানান, ‘এভাবে কাজ করায় হাঁটুতে ব্যথা হচ্ছে, মাথা ঘুরছে, কাধে ব্যথা হচ্ছে। ওষুধ খেয়েও লাভ হচ্ছে না। এভাবে ২ বছরের বেশি কাজ করা সম্ভব হবে না।’
আরেক শ্রমিক খলিলুর রহমান বলেন, ‘এখানে বলা হয়েছিল সব ছোট বস্তা হবে। এই শর্তে কাজে যোগ দিয়েছি। কিন্তু এখন সব বড় বস্তা রাখা হচ্ছে। মহাজনকে বলেও কোনও কাজ হচ্ছে না। কাজ না করলে হুমকি দিচ্ছে। কারণ অগ্রিম টাকা নিয়েই কাজে যোগদান করেছি এখানে।’
রাহবার হিমাগারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওসমান গণি বলেন, ‘কৃষকরা বড় বস্তা ছাড়া দিচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়েই বড় বস্তা নিতে হচ্ছে। তবে এই বড় বস্তার সংখ্যা অনেক কম।’
ওই হিমাগারের ব্যবস্থাপক আপেল চৌধুরী বলেন, ‘বড় বস্তা রাখা যাবে না এমন কোনও চিঠি আমরা এখনও পাইনি। তবে ৫০ কেজির বেশি ওজনের বস্তা নেওয়া যাবে না এমনটি শুনেছি। এই হিমাগারে ৮৪ কেজি ওজনের বেশি বস্তা নেই।’
দিনাজপুরের সুইহারী হিমাগারেরও একই অবস্থা। এই হিমাগারে যেসব বস্তা রাখা হচ্ছে সেসবের ওজনও ৮০ থেকে ১০০ কেজি করে। তবে এখানকার শ্রমিকরা এ ব্যাপারে কোনও কথা বলতে রাজি হননি। এ ব্যাপারে ওই হিমাগারের হিসাবরক্ষক বীরেশ্বর বসাক বলেন, ‘এবারে ৫০ কেজি ওজনের বেশি বস্তা নেওয়া যাবে না এই বিষয়টি কৃষকসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে জানানো হয়েছে। তবে এটি অনেক হিমাগার মানছে না, বাধ্য হয়ে বেশি ওজনের বস্তা নিতে হচ্ছে। নাহলে লোকসানে পড়তে হবে। তবে পর্যায়ক্রমে এই নিয়মটি করা হবে।’
দিনাজপুর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদফতরের উপ-মহাপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘৫০ কেজি ওজনের বেশি বস্তা রাখা যাবে না এজন্য হিমাগারগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন হিমাগারে পরিদর্শন করা হচ্ছে। অসঙ্গতি পেলে বিভাগীয় শ্রম আদালতে মামলা দায়ের করা হবে। ৩০ দিনের একটি কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে যাতে বিভিন্ন রুটে ভাগ করে হিমাগারগুলো পরিদর্শন করা হচ্ছে। ৫০ কেজির ঊর্ধ্বে কিছু বস্তা পাওয়া যাচ্ছে এবং এ ব্যাপারে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। আরও কিছুদিন বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। যেই হিমাগারই হোক অসঙ্গতি পেলে মামলা দায়ের করা হবে। এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্স গ্রহণ করা হবে।’
//এআরএইচ//