Ultimate magazine theme for WordPress.

যশোরে একই জমিতে বছরে ছয়টি ফসল

0

যশোর প্রতিনিধি : দুই তিন কিম্বা চার নয়, বছরে এবার ছয় ফসল ঘরে তুলতে পারবেন কৃষক। গবেষণার পর এমনই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন যশোর আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিকরা। ইতোমধ্যে সুফলও মিলতে শুরু করেছে। বাড়ছে জনসংখ্যা। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে কমছে কৃষি জমি। ক্রমবর্ধমান এই জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে তাই একই জমিতে বছরে ছয়টি ফসল উৎপাদনের পন্থা এখন কৃষকের হাতে।

যশোর কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান জানান, প্রতি বছর ১.১৪% হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে আগামী ২০৩০ সালে জনসংখ্যা বাংলাদেশের হবে ১৯১.১ মিলিয়ন (৫১.৪%) এর ২০৫০ সালে হবে ২১২.৫ মিলিয়ন। অর্থাৎ প্রতিবছরে জনসংখ্যা বহরে ১.৭ মিলিয়ন জনসংখ্যা যুক্ত হবে। তিনি বলেন, বিপুল জনসংখ্যায় অধ্যূষিত (প্রায় ১৬ কোটি) ৫৬,৯৭৭ বর্গমাইলের বাংলাদেশ বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনে সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম। জনসংখ্যার উচ্চ বৃদ্ধি (প্রায় ১.৩৭%) এবং প্রতি বছর আবাদি জমির ক্রমাগত হ্রাস ( প্রায় ১% হারে) খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির স্বাভাবিক গতি ও প্রক্রিয়াকে প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্থ করে চলেছে। বর্তমান আবাদযোগ্য জমির (প্রায় ৮৫.০৫ লক্ষ হেক্টর) মধ্যে এক ফসলি জমি ২৮.৭০%, দুই ফসলি জমি ৪৪.৯২%, তিন ফসলি জমি ১৯.২৬% এবং ফসলের নিবিড়তা ১৯১%।

আবাদি জমির অনুভূমিক বিস্তারের কোন সুযোগ না থাকায় বর্তমান চাষযোগ্য জমিতেই বর্ধিত জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা খুবই জরুরি। তাই বর্তমানে আবাদী ৮.৫ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে উৎপাদিত প্রায় ৪০ মিলিয়ন টন (ধান,গম,ভূট্টা, ডাল ও তেলবীজসহ) খাদ্য শস্য দিয়ে আগামী ২০৫০ সালের বাড়তি জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা মেটাতে অতিরিক্ত ১০-১২ মিলিয়ন টন খাদ্য শস্য প্রয়োজন হবে। এই বাড়তি জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা মেটাতে ও দীর্ঘমেয়াদী মাটির স্বাস্থ্য সংরক্ষণে এ ধরণের ফসল শস্যবিন্যাসের বিকল্প নেই।

কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালিত গবেষণায় জানা গেছে, উন্নত ফসলধারা প্রবর্তনের সম্ভবনাকে কাজে লাগিয়ে ফসলের নিবিড়তা ১৯১% থেকে ৪০০% পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। গবেষনায় দেখা গেছে, রোপা আমন-পতিত-বোরো একটি অন্যতম ফসলধারা হিসেবে বিবেচিত যা প্রায় মোট চাষযোগ্য জমির ২২%। সরিষা, মসুর, ছোলা, খেসারী ও আলু খুবই গুরুত্বপূর্ণ ফসল যা শুধু রবি মৌসুমে চাষ করা হয়। অতীতে যে সকল জমিতে রবি ফসল চাষ হতো সেচ সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ায় সে সকল জমি এখন বোরো ধান চাষের আওতায় চলে গেছে। এতে দিন দিন ডাল, তেল, আলু ও শাক-সবজী ফসলের জন্য আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ডাল চাষে ব্যবহৃত জমির পরিমাণ ৭.৪৮ লক্ষ হেক্টর যা মোট জমির শতকরা মাত্র ৫.৩ ভাগ এবং উৎপাদিত ডালের পরিমাণ ৫.৩৫ লক্ষ মেট্টিক টন।

আমাদের দেশে যে ডাল উৎপাদন হয় তা দিয়ে আমাদের জনপ্রতি প্রতিদিন ১০ গ্রাম ডালের সংস্থান হয়। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্ব খাদ্য সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী সুষম খাদ্য তালিকায় একজন মানুষের জন্য প্রতিদিন নূন্যতম ৪৫ গ্রাম ডাল থাকা প্রয়োজন।

এ হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে আমাদের প্রায় ২৬ লক্ষ মেট্টিক টন ডাল উৎপাদন করা প্রয়োজন। একই হারে বাড়তি জনগোষ্ঠীর ডালের চাহিদা মেটাতে হলে উৎপাদন বাড়াতে হবে ১.১৬ লক্ষ মেট্টিক টন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশীয় ভোজ্য তেলের চাহিদার পরিমান দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের দেশে প্রায় ৫.৩২ লক্ষ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয় এবং উৎপাদন প্রায় ৫.৯৬ লক্ষ মেট্রিক টন। দেশীয় ভোজ্য তেলের উৎপাদনের পরিমান খুবই কম যা চাহিদার ৩ ভাগের ১ ভাগ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্ব খাদ্য সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী একজন মানুষের প্রতিদিন নূন্যতম ২২ গ্রাম তেল খাওয়া প্রয়োজন কিন্তু আমাদের দেশে যে তেল উৎপাদন হয় তা দিয়ে আমাদের জনপ্রতি প্রতিদিন ১৬ গ্রাম তেলের সংস্থান হয়।এই চাহিদা পূরণ করার জন্য আমাদের প্রায় ১২.৮ লক্ষ মেট্টিক টন তেল উৎপাদন করা প্রয়োজন। রোপা আমন-পতিত-বোরো ফসল ধারায় বোরো ধান চাষে প্রচুর পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করতে হয় (প্রায় ৩০০০-৫০০০ লিটার পানি এক কেজি ধান উৎপাদনে) ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যায়, অনেক সময় ভূমি দেবে যায়, মাটিতে লবণাক্ততা, আয়রন ও আর্সেনিক দূষণ ইত্যাদি পরিবেশগত সমস্যার সৃষ্টি হয়।

অন্যদিকে রবি মৌসুমে চাষকৃত ফসল যেমন আলু, সরিষা, মটরশুটি, মুগডাল ও শাক-সবজী ইত্যাদি চাষে ২-৩টি সেচের প্রয়োজন হয়। চার-পাঁচ-ছয় ভিত্তিক ফসল ধারায় বিকল্প ফসল হিসেবে স্বল্প পানি নির্ভরশীল সরিষা, আলু, মুগডাল, মটরশুটি ও শাক-সবজী চাষ করলে ভবিষ্যতের জন্য অনেক পানি (হেক্টরপ্রতি ১২.৬৯ মিলিয়ন লিটার) সংরক্ষণ করা সম্ভব। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের, কৃষিতত্ত্ব বিভাগ ও আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, যশোর কর্তৃক নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কৃষকের জন্য লাভজনক ও পরিবেশবান্ধব ছয় ফসল ভিত্তিক ফসল ধারা চিহ্নিত করে।

যশোর কৃষি গবেষণা কেন্দের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জানান, নতুন পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে ২ প্রকারের ধানের পাশাপাশি মুগডাল, মটরশুটি কিম্বা লাল, সবুজ, পালংশাক, ধনিয়াপাতার যেকোন ধরণের দু’টি সবজি চাষ করে বছরে এখন ছয়টি ফসল সহজেই ঘরে তুলতে পারবেন কৃষকরা। এতে খরচ-খরচা বাদ দিয়ে বছরে অন্তত ৩ লাখ টাকা লাভ করতে পারবেন কৃষকরা, এমনটাই দাবি বৈজ্ঞানিকদের। দু’ফসলী জমিতে বছরে ছয়টি ফসল তুলতে পেরে ইতোমধ্যেই লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছেন চাষীরা। এরআগে ২০১৫ সালে ৫ ফসল করে দেশব্যাপী সাড়া ফেলেছিল যশোর আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা।
//এআরএইচ//

Leave A Reply

Your email address will not be published.