Ultimate magazine theme for WordPress.

ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্ব বাড়ছে নগরকৃষির

0

* আতিকুর রহমান *
বাড়ছে জনসংখ্যা। বাড়ছে খাদ্যের চাহিদা। কিন্তু খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ সেই তুলনায় বাড়ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন- ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৯০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে এবং পৃথিবীতে নগরবাসীর সংখ্যা হবে ৩৫০ কোটির ওপর। ফলে এই বিশাল নগরীয় জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পৃথিবীকে এক বিরাট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। দূরবর্তী গ্রামাঞ্চল থেকে খাদ্যদ্রব্য এনে নগরবাসীর খাদ্য ও পুষ্টিচাহিদা পূরণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ওই সময়ে লাতিন আমেরিকার শতকরা ৮৫ ভাগ এবং আফ্রিকা ও এশিয়ার প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ দরিদ্র মানুষ ক্ষুধা, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যদূরীকরণের আশায় নগরগুলোয় ভিড় জমাবে। নগরের মানুষ তাদের আয়ের শতকরা ৩০ ভাগ অর্থ খাদ্য ক্রয় কাজে ব্যয় করেও গ্রামের মানুষের চেয়ে বেশি অপুষ্টিতে ভুগছেন।

নগর ও তার আশপাশের এলাকায় নগরবাসীর জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন, প্রত্রিয়াকরণ, বাজারজাতকরণ ও বিতরণ ব্যবস্থাকেই নগরীয় বা নগরকৃষি নামে অভিহিত করা হয়। উদ্যান ফসল বিশেষ করে শাকসবজি, ফল-মূল, ওষুধি উদ্ভিদের চাষ, কৃষি বনায়ন, শহর সবুজায়ন, মাশরুম চাষ, হাঁস-মুরগি, গবাদি পশু পালন, মৎস্য চাষ এবং মৌমাছি পালনসহ কৃষির এসব কর্মকা-কেই নগরীয় কৃষিতে প্রাধান্য দেওয়া হয়।

নগরীয় কৃষি টাটকা শাকসবজি, ফল-মূল সরবরাহের মাধ্যমে নগরবাসীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। নগরবাসীর কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্যবিমোচনে সহায়তা করে। নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নগরবাসীর সুস্বাস্থ্য রক্ষা করে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নগরীয় কৃষি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। তাই জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ঘনবসতিপূর্ণ নগরগুলোয় নগরীয় কৃষিব্যবস্থা গড়ে তুলতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার ও নগর কর্তৃপক্ষকে নগরীয় কৃষি সংগঠন গড়ে তুলতে, অবকাঠামো নির্মাণে, কারিগরি সহায়তা প্রদানে এবং হাইড্রোপনিক্সের মাধ্যমে ক্ষুদ্র বাগান ও ছাদ বাগান তৈরির কাজে সহায়তা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, আফ্রিকার ১৩০ মিলিয়ন এবং লাতিন আমেরিকার ২৩০ মিলিয়ন নগরবাসী নগরীয় কৃষি বিশেষ করে উদ্যান ফসল উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা নগরীয় কৃষির মাধ্যমে কৃষিপণ্য উৎপাদন করে পারিবারিক চাহিদা পূরণের পর অতিরিক্ত কৃষিপণ্য বিক্রি করে বাড়তি অর্থও আয় করছেন। ২০০০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পৃথিবীতে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা শতকরা ২৭ ভাগ হ্রাস পেলেও সারা পৃথিবীতে এখনো ৮ দশমিক ৫ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধার যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে। বৈশ্বিক অনাহার সূচক-২০১৭ অনুসারে পাঁচ বছরের নিচের বয়সের শিশুদের মধ্যে শতকরা ৪৫ ভাগ শিশুর মৃত্যু ঘটে অপুষ্টিজনিত কারণে।

বর্তমানে বিশ্বে মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি লোক নগরে বসবাস করে এবং বিশ্বে উৎপাদিত মোট খাদ্যের শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ আসে নগরীয় কৃষি থেকে। ২০৫০ সালে পৃথিবীর শতকরা ৬৭ ভাগ লোক নগরে বসবাস করবে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার অন্য এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পৃথিবীর প্রায় ৮০ কোটি লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নগরীয় কৃষির সঙ্গে জড়িত এবং ২০ কোটি নগরবাসী বিক্রির জন্য খাদ্য উৎপাদন করে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের আগে কিউবাতে জ্বালানি ও কৃষি উপকরণের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দেয়। পতনের আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কিউবা এসব পণ্য চিনির বিনিময়ে আমদানি করত। ফলে ১৯৯০ সালের প্রথমদিকে কিউবাতে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দেয়। কিউবা তখন নগরীয় কৃষির মাধ্যমে সেই সংকট সমাধান করতে সক্ষম হয়। ২০০২ সালে কিউবাতে ১৪০০ হেক্টর নগরীয় বাগান থেকে মোট ৩৪ লাখ টন খাদ্য উৎপাদিত হয়। হাবানা নগরের শতকরা ৯০ ভাগ টাটকা শাকসবজি, ফল-মূল, মাংস, ডিম ও দুধ আসে নগরীয় কৃষি থেকে। কিউবাতে ২০০৩ সালে ২ লাখেরও বেশি মানুষ বিকাশমান নগরীয় কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। চীনের সাংহাইয়ে চাহিদার শতকরা ৬০ ভাগ শাকসবজি, ১০০ ভাগ দুধ, ৯০ ভাগ ডিম এবং ৫০ ভাগ মাংস উৎপাদিত হয় নগরীয় কৃষির মাধ্যমে। জাপানের নগরে বসবাসরত শতকরা ২৫ ভাগ পরিবার নগরীয় কৃষির সঙ্গে জড়িত। টোকিও শহরে প্রায় সাত লাখ নাগরিকের সবজি আসে নগরীয় কৃষি থেকে। নেদারল্যান্ডস নগরীয় কৃষির মাধ্যমে নিজ দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণের পর প্রচুর কৃষিপণ্য বিদেশের বাজারে রফতানি করে।

১৯৭০ সালে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন। ৪৭ বছরের ব্যবধানে ২০১৮ সালে দেশে জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৩৫ লাখ। বর্তমানে দেশে ৩ কোটি ৮৬ লাখ টনের বেশি চাল উৎপাদিত হচ্ছে। যে জমিতে আগে হেক্টরপ্রতি দুই টন চাল উৎপাদিত হতো, এখন সেখানে উৎপাদন হচ্ছে ৪ টন। ইউএনডিপির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৮০ সালে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল শতকরা ২.৮৫ ভাগ এবং ২০১৪ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে শতকরা ১.২২ ভাগে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২১ সাল নাগাদ দেশের মোট জনসংখ্যা ১৮ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এই হিসাবে ২০৫০ সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ২১ কোটি ৫৪ লাখ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, উৎপাদন গতিশীলতার এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে চালের উৎপাদন হবে ৪ কোটি ৭২ লাখ টন এবং ২১ কোটি ৫৪ লাখের লোকের জন্য চালের প্রয়োজন হবে ৪ কোটি ৪৬ লাখ। অর্থাৎ ২০৫০ সালে বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় না হলে দেশে ২৬ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। শুধু চাল দিয়েই কি দেশের অপুষ্টিসমস্যা দূর করা সম্ভব হবে? ২০০৪-০৫ সালে বাংলাদেশে অপুষ্টির শিকার মানুষের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৩৭ লাখ, এখন ২ কোটি ৪৪ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৫ দশমিক ১ ভাগ-বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। পুষ্টিকর খাবার ছাড়া ভবিষ্যতে মেধাবী প্রজন্মের প্রত্যাশা করা যায় না।

অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, বাড়ি-ঘর, কল-কারখানা, রাস্তাঘাট নির্মাণ, নদীভাঙন ও ওপরের উর্বর মাটি দিয়ে ইট তৈরির কারণে দেশে প্রতি বছর দশমিক ৭৭ ভাগ হারে কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে। এ ছাড়া মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার, বালাইনাশক ব্যবহার ও তরল শিল্প বর্জ্য নিক্ষেপের কারণে দিন দিন কৃষিজমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। দ্রুত নগরায়ণ, মাথাপিছু আয়, শিক্ষার হার বৃদ্ধি ও মানুষের পুষ্টি সচেতনতার কারণে টাটকা, শাকসবজি, ফল-মূল, মাছ, মাংস, দুধ ও ডিমের চাহিদা বাড়ছে ব্যাপকভাবে। সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের সুযোগের অভাব এবং ত্রুটিপূর্ণ পরিবহন ও বাজার ব্যবস্থার কারণে উৎপাদিত শাকসবজি ও ফল-মূলের ২৫ থেকে ৩০ ভাগ নষ্ট হয়ে যায়।

অন্যদিকে পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে দূরবর্তী স্থান থেকে কৃষিপণ্য এনে নগরবাসীর খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা ভবিষ্যতে পূরণ করা সম্ভব হবে না। কারণ, বর্তমানে প্রায় পাঁচ কোটি লোক নগরে বসবাস করছে। ২০২০ সালে সাড়ে আট কোটি এবং ২০৫০ সালে ২১ কোটি ৫৪ লাখ লোক নগরে বসবাস করবে। তখন সমস্ত দেশটিই নগরে পরিণত হবে।

সম্প্রতি বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প বাস্তবায়নে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয় বোর্ড। চুক্তি অনুযায়ী প্রতিদিন আড়াই হাজার টন বর্জ্য থেকে ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন বিনামূল্যে বিদ্যুৎপ্লান্টে বর্জ্য পৌঁছে দেবে। বিদ্যুৎ বিভাগ ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রস্তাব দিয়েছে।

বর্জ্য থেকে শুধু বিদ্যুতের পাশাপাশি জৈব সারও উৎপাদন করতে হবে এবং সেই জৈব সার নগরীয় কৃষিকাজে ব্যবহার করতে হবে। এ জন্য প্রতিটি নগরে নগর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নগরীয় কৃষিব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। কমপক্ষে দুটি ওয়ার্ডের জন্য একটি উপসহকারী নগরীয় কৃষি কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি করতে হবে।

নগরের প্রতিটি বসতবাড়ি, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালতের ছাদে, অব্যবহৃত জায়গায় শাকসবজি ও ফল-মূলের বাগান সৃষ্টি করতে হবে। ছোট ছোট চৌবাচ্চায় আধুনিক পদ্ধতিতে তেলাপিয়া মাছের চাষ করতে হবে। হাড্রোপনিক্স পদ্ধতিতে মাটি ছাড়াই শাকসবজি ও ফল-মূল উৎপাদনের উদ্যোগ নিতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে মাশরুম চাষের।

নগরবাসীর পুষ্টি চাহিদা পূরণের জন্য নগর ও তার আশপাশে প্রয়োজনীয় পোলট্রি ও ডেয়ারি খামার গড়ে তুলতে হবে। এসব কাজে নগর কর্তৃপক্ষকে কারিগরি সহায়তা ও প্রণোদণা প্রদান করতে হবে। নগর কৃষকরা যাতে তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য ন্যায্য দামে বিক্রি করতে পারে, সে জন্য প্রতিটি নগরে নগরীয় কৃষিবাজার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের নগরগুলোয় এ ধরনের নগরীয় কৃষিবান্ধব বাজার রয়েছে।

নগরকৃষির সঙ্গে গ্রামীণ কৃষির অনেক পার্থক্য আছে এবং দ্রুত নগরায়ণকে আমরা কোনোভাবেই ঠেকিয়ে রাখতে পারব না। তাই বিদেশের মতো করে নয়; আমাদের মাটি, আবহাওয়া, খাদ্যাভ্যাস, নগরায়ণ, পুষ্টিচাহিদা, মাথাপিছু আয়, আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে সংগতি রেখে আমাদের মতো করে গ্রামীণ কৃষির পাশাপাশি নগরীয় কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

নেদারল্যান্ডস ও কিউবা যদি নগরীয় কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে তাদের দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে আমরা পারব না কেন? আমাদের কৃষিকাজে দক্ষ জনশক্তি আছে, আধুনিক প্রযুক্তি আছে। আছে উপযুক্ত আবহাওয়া ও পরিবেশ। কৃষিবিজ্ঞানী, গবেষণা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও অভাব নেই। প্রয়োজন শুধু সাহস করে সরকারিভাবে নগরীয় কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন-এটা এখন সময়ের দাবি। কারণ, ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হবে নগরীয় বাংলাদেশ ও নগরকৃষির বাংলাদেশ।
//এআরএইচ//
* লেখক: সাংবাদিক

Leave A Reply

Your email address will not be published.