নাটোর প্রতিনিধি : দেশের সর্বাধিক রসুন উৎপাদনকারী জেলা নাটোরে চলতি রবি মৌসুমে ২৬ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে রসুন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বীজ হিসেবে ব্যবহারের জন্যে রসুনের কোয়া ছড়ানো এবং ওইসব রসুনের কোয়া বুনতে নারী-পুরুষের যৌথ অংশগ্রহণে গ্রামীণ জনপদে এখন চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। লক্ষ্যমাত্রার জমি আবাদে নিয়োজিত শ্রমের মোট আর্থিক মূল্য ১১৬ কোটি টাকা।
নাটোরে উৎপাদিত রসুনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- বিনা চাষে রসুন উৎপাদন। নাটোরে রসুনের আবাদী জমির প্রায় পুরোটাই বিনা চাষের রসুন। ১৯৯৪-৯৫ সালে জেলার সীমান্তবর্তী বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর উপজেলার কৃষকরা স্বপ্রণোদিত হয়ে বিনা চাষে রসুন আবাদ করেন।
গুরুদাসপুর উপজেলার কাছিকাটা এলাকার কৃষক জেহের আলী কার্তিক মাসে বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার পর জমিতে রসুনের কোয়া বুনে বিনা চাষে রসুন উৎপাদনের সূত্রপাত করেন। প্রচলিত পদ্ধতিতে জমি চাষ করে রসুন লাগানো হলেও এ পদ্ধতিতে রসুন আবাদে জমি চাষ করতে হয় না, সেচও লাগেনা। আগাছা থাকে কম এবং সারের ব্যবহার খুবই কম। উৎপাদন ব্যয় তুলনামূলক কম হওয়ার পাশাপাশি উৎপাদনের পরিমাণ বেশি হওয়ায় এ পদ্ধতি কৃষকদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। প্রসার ঘটেছে জেলার অন্যসব উপজেলা ছাড়িয়ে দেশের অন্যান্য জেলাগুলোতে।
জেলার বেশিরভাগ রসুন উৎপাদিত হয় গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম উপজেলায়। এসব এলাকাসহ সর্বত্র কৃষকরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন মাঠে রসুন বুনতে। এ কাজে পুরুষের পাশাপাশি নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। সিংড়া উপজেলার ধুলিয়াডাঙ্গা এলাকার প্রায় একশ’ বিঘা জমিতে কৃষকরা রসুন চাষ করছেন। মিজনুর রহমানের দেড় বিঘা জমিতে কর্মরত সাতজনের মধ্যে তিনজনই নারী শ্রমিক। কর্মরত ছমিরন বলেন, পুরুষদের মজুরী সাড়ে তিনশ’ টাকা হলেও আমরা দিনে আড়াইশ’ টাকা পাই। একবিঘা জমি বুনতে ১৫ থেকে ১৬ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয় বলে জানান কৃষক আনসার আলী। মাঠ জুড়ে একদিকে চলছে রসুন বোনা, অন্যদিকে যুগপৎভাবে চলছে বোনা রসুনকে ধানের বিছালী দিয়ে ঢেকে দেওয়ার কাজ। বিছালী ঢাকা জমিন থেকে বেরিয়ে আসবে রসুন গাছের সবুজ অঙ্কুরোদগম, ফলবে রাশি রাশি রসুন, ঘটবে শ্বেত বিপ্লব।
মাঠের মত কৃষক পরিবারের বাড়িতেও একই রকম ব্যস্ততা। বাড়ির সকল সদস্যকে সাথে নিয়ে মেয়েরা মেতে উঠেছেন রসুনের কোয়া ছড়ানোর কাজে। যেন এ কাজে তাদেরই পারদর্শিতা বেশি। বড় সাঁঐল গ্রামের কৃষক বধূ রেবেকা ইসলাম জানান, এ কাজে বাড়ির সদস্য ছাড়াও মহিলা শ্রমিক নেয়া হয়, এক মণ রসুনের কোয়া ছড়াতে পারিশ্রমিক তিনশ’ টাকা। সাধারণত এক বিঘা জমিতে রসুন বুনতে আড়াই থেকে তিন মণ রসুনের বীজ প্রয়োজন হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে ২৬ হাজার ৬৫০ হেক্টর অর্থাৎ এক লাখ ৯৯ হাজার ৮৭৫ বিঘা জমির রসুন বুনতে প্রায় ৩০ লাখ জন শ্রমিকের তিন-চতুর্থাংশ পুরুষ হলে, তাদের মোট সংখ্যা সাড়ে ২২ লাখ এবং জনপ্রতি ৩৫০ টাকা হিসেবে তাদের সমষ্টিক পারিশ্রমিক ৭৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। অন্যদিকে, রসুন বুনতে কর্মরত এক-চতুর্থাংশ অর্থাৎ সাড়ে ৭ লাখ নারী শ্রমিকের মোট পারিশ্রমিক ২২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পাশাপাশি, জমিতে মোট প্রয়োজনীয় ২০ টন বীজ ছড়াতে প্রায় পাঁচ লাখ নারী শ্রমিকের মোট পারিশ্রমিক মণ প্রতি ৩০০ টাকা হিসেবে ১৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এ কর্মযজ্ঞে মোট শ্রমের আর্থিক মূল্যমান দাড়াচ্ছে ১১৬ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা।
বড়াইগ্রাম উপজেলার তিরাইল গ্রামের রসুন চাষি তোফাজ্জল হোসেন চলতি মৌসুমে দুই বিঘা জমিতে রসুন আবাদ করছেন। তিনি বলেন, অনুকূল আবহাওয়া বিরাজ করায় রসুন বীজের অঙ্কুরোদগম ভাল হচ্ছে, আশাকরি ফলনও ভালো হবে। তবে গত বছরে ১২ বিঘা জমিতে রসুন আবাদ করে দুই হাজার টাকা মণের রসুন মাত্র ৩০০ টাকায় নেমে যাওয়ায় লোকসান দিতে হয়েছে অনেক। তাই এবার আবাদ কমিয়ে দিয়েছি। তবে অনেক কৃষক আশা প্রকাশ করেছেন, গত বছর রসুনের দাম কমে গেলেও এবার দাম বাড়তি হবে। তাই গতবারের লোকসান এবার পুষিয়ে নেয়া যাবে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি রবি মৌসুমে জেলায় ২৬ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে রসুন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বড়াইগ্রাম উপজেলায় সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৩৪৭ হেক্টর, গুরুদাসপুর উপজেলায় ছয় হাজার ৬৬১ হেক্টর, নাটোর সদর উপজেলায় দুই হাজার ৭৭৬ হেক্টর, লালপুর উপজেলায় দুই হাজার ১২৩ হেক্টর, সিংড়া উপজেলায় এক হাজার ৩৩২ হেক্টর, বাগাতিপাড়া উপজেলায় ৭৮৬ হেক্টর এবং নলডাঙ্গা উপজেলায় ৬২৫ হেক্টর। ইতোমধ্যে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমি রসুন আবাদের আওতায় এসেছে। আর ফলনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় দুই লাখ টন।
বড়াইগ্রাম উপজেলা কৃষি অফিসার ইকবাল আহমেদ বলেন, বিগত দুই দশকে নাটোরে কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈচিত্রকরণ হয়েছে। কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কৃষি বিভাগের নতুন প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের সমন্বয়ে প্রচলিত শস্যের বাইরে কৃষকরা অপ্রচলিত কিন্তু লাভজনক শস্যের প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন। এক্ষেত্রে রসুন অগ্রগামী শস্য। বর্তমানে রসুন উপজেলার সবচেয়ে লাভজনক শস্য।
উপজেলা কৃষি অফিসার আরও বলেন, অনুকূল আবহাওয়া, মানসম্মত বীজের সহজলভ্যতা, সারের পরিমিত ও আদর্শ বাবহারের পাশাপাশি কৃষি বিভাগের প্রশিক্ষণ ও তদারকিতে রসুনের আশাতীত ফলন হবে। তিনি বলেন, বাজারে কৃষকরা রসুনের প্রত্যাশিত দাম পেলে একসময় রসুন এ এলাকার প্রধান অর্থকরী ফসলে পরিণত হবে।
//এআরএইচ//