Ultimate magazine theme for WordPress.

কৃষি বিভাগের ব্যবস্থাপনায় উদ্ভিদের নিবিড় চিকিৎসালয়

0

কৃষিখবর প্রতিবেদক : সাত রংয়ে মিশেল ডাউস ছাতার নিচে আড়াআড়ি বসানো টেবিল। মুখোমুখি ক‘টি প্লাস্টিক চেয়ার। দুটিতে বসা চৌকষ দুকর্মী। টেবিলে রাখা হরেক প্রজাতির ফল-ফসলের লতাগুল্ম, কান্ড, ফল নেড়ে দেখছেন। রোগের বর্ণনা শুনে প্রেসক্রিশন লিখছেন। লাইনে দাড়ানোদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। এখানে রোগী গাছ, লতাপাতা, ফল ও সবজি। ডাক্তার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষিবিদরা। সারিতে দাড়ানোরা কৃষক। তাদের হাতে যাচ্ছে ব্যবস্থাপত্র। উদ্ভিদ চিকিৎসায় অভূতপূর্ব এ কেন্দ্রের নাম প্লান্ট ডক্টর ক্লিনিক।
সম্প্রতি মধুপুর উপজেলার ভবানিটিকি বাজারে এ প্লান্ট ডক্টর ক্লিনিক উদ্ধোধন হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এর উৎগাতা। বহুলখ্যাত আন্তর্জাতিক সংস্থা কমনওয়েলথ এর সহযোগিতায় দেশের পাঁচ জেলার দশ উপজেলায় পাইলট প্রজেক্ট হিসাবে প্ল্যান্ট ডক্টর ক্লিনিক চালু করা হয়েছে।

টাঙ্গাইলের মধুপুর ও টাঙ্গাইল সদর উপজেলা, শেরপুরের নকলা ও নালিতাবাড়ি, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা ও ফুলপুর, গাজীপুরের কাপাসিয়া ও কালিয়াকৈর এবং ঢাকার সাভার ও ধামরাই উপজেলায় এ ধরনের ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে।

মধুপুরে এ কিøনিক দেখতে কৃষকদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখা যায় । বাজার ভেদ করে যাওয়া পাঁকা সড়কের ডান পাশে চেয়ারটেবিল সাজিয়ে বসা ক্লিনিকে কাজ করছেন মধুপুর উপজেলার উপসহকারি উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা ও প্ল্যান্ট ডাক্তার শাহাদৎ হোসেন এবং উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা তাপস কুমার সরকার। কুড়াগাছা গ্রামের সবজি চাষী আলমগীর এসেছেন একগাদা ফল ও সবজি নিয়ে। এক বিঘায় করলা, দেড় বিঘায় শসা এবং দুই বিঘায় ঝিঙে, দুন্দল ও মিষ্টি কুমড়ার আবাদ করেছেন। এছাড়াও রয়েছে কাঁঠাল ও কলার আবাদ। জমির শসা গাছের পাতা কুঁকড়ে যাচ্ছে। গোড়া ফেঁটে কষ বেরিয়ে গাছ মারা যাচ্ছে। ঝিঙে ও কুমড়ায় ফল ছিদ্রকারি পোকার ব্যাপক উপদ্রব। রোগাক্রান্ত শসা ও কুমড়াও আনা হয়েছে। প্লান্ট ডাক্তার শাহাদৎ হোসেন প্রেসক্রিপশন দিলেন। ওষুধের পাশাপাশি মাছি পোকা দমনে সেক্স ফেরোমেন পদ্ধতি গ্রহনের ও পরামর্শ দেয়া হলো।

কর্তব্যরত প্লান্ট ডাক্তার বর্ণনা শুনে এবং আলামত নিরীক্ষা করে ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন তিনি জানান, কীটনাশক প্রয়োগ ছাড়াও প্রাকৃতিক উপায়ে পোকা দমন করা যায়। অধিকাংশ কৃষক কীটনাশক ডিলারের কাছে শুনে পোকা বা রোগ দমনে বিষ প্রয়োগ করে। এতে ডিলার বিষের সাথে অপ্রয়োজনীয় সার ও হরমোন গছিয়ে অর্থনৈতিকভাবে শোষন করে।

স্বল্পখরচে প্রাকৃতিক উপায়ে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে রোগবালাই দমনে পরামর্শ মেলেনা। বাড়তি বিষ প্রয়োগে পরিবেশের বিনাশ হয়। বিষ প্রয়োগে বন্ধু পোকাও নিধন হয়। এজন্য উপকারি পতঙ্গ মৌমাছি বিলীন হচ্ছে। উপকারি পোকা নির্বিচারে নিধনে ফল-ফসলের পরাগায়ন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ সময় হাজির ভবানিটিকি গ্রামের আরেক সবজি চাষী আব্দুর রাজ্জাক। তিনি জানান, ছত্রাকজনিত কারণে তার বেগুন গাছ মারা যাচ্ছে। কুমড়া, করলা, ভেঢস ও শসার ফলণে ব্যাপক মন্দা। কর্তব্যরত প্লান্ট ডাক্তার বর্ণনা শুনে এবং আলামত নিরীক্ষা করে পরাগায়নের অসুবিধায় ফলণ বিপযর্য়ের তথ্য জানালেন। সে মতে ব্যবস্থাপত্র ও দেয়া হলো।

একইভাবে পিরোজপুর গ্রামের হাসেন আলী, কুড়াগাছার মোতালেব হোসেন, আঙ্গারিয়ার কদ্দুস মন্ডল, মমিনপুরের আব্দুল হাইসহ শতাধিক কৃষক হাজির ফল-ফসলে পোঁকা ও রোগাক্রান্ত হওয়ার বৈচিত্র্যময় সমস্যা নিয়ে। ক্লিনিকের পাশেই হলো কৃষক সমাবেশ।

বাজারের কীটনাশক ও সার ডিলার জয়নাল আবেদীন জানান, কুড়াগাছা ইউনিয়নের ভবানিটিকি, চাঁপাইদ, পিরোজপুর, পীরগাছা, মমিনপুর, ধরাটি ও আঙ্গারিয়া এবং মির্জাবাড়ি ইউনিয়নের বিশনাইপাল, ব্রাম্মণবাড়ি, কেতনপুর, আমবাড়িয়া, হাজিপুর, পালবাড়ি ও মির্জাবাড়ি এখন সবজির গ্রাম।

মধুপুর গড়ের লালমাটির এ অংশের যেদিকে তাকানো যায় শুধু সবজি আর সবজি। কলার আবাদ হ্রাস পেয়ে সবজির আবাদ বাড়ছে হুহু করে। কুড়াগাছা ও ভবানিটিকি বাজারেই গড়ে উঠেছে সবজির পাইকারি আড়ত। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকার এসে কেনা সবজি ট্রাকে ভরে নিয়ে যাচ্ছে। সবজির দামও বেশ চড়া থাকে। আবাদ করে কৃষকরা আর্থিক স্বাচ্ছন্দ বৃদ্ধি করেছেন। তবে লাভজনক সবজি চাষকে কেন্দ্র করে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বেনিয়া কীটনাশক ও হরমোন কোম্পানি।

কলা আর আনারসকে অস্বাস্থ্যকর খাদ্যে পরিণত করার পর বেনিয়াদের টার্গেট এখন সবজি সেক্টর। সেদিনের কৃষক সমাবেশের ব্যানারে বড় অক্ষরে নাম ছিল পেস্টিসাইজ অফিসার্স এসোসিয়েশনের নাম। সরকারি অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় তাদের গলাবাজিরও কমতি ছিলনা।

মঞ্চের অদূরেই দেখা গেল বিষ কোম্পানি বায়ার ক্রপ সাইন্স গ্রুপের কৃষি সেবা কেন্দ্র। নাম ক্রপ ক্লিনিক। অনুষ্ঠানে উপস্থিত বায়ারের জেলা কর্মকর্তা কৃষিবিদ মাসুম বিল্লাহ জানান, ‘৬মাস আগে কোম্পানি ভবানিটিকি বাজারের মাসুদ মিলিটারির ভাড়াটে ঘরে এ ক্রপ ক্লিনিক চাল হয়। স্টাফ ওয়ারেস আলীর এখানে প্রতিদিন ২টার পর বসার কথা। কৃষকদের সমস্যা শুনে ব্যবস্থাপত্র দেয়ার কথা। বাজারের ক‘জন দোকানদার জানান, মূলত বিষ বিক্রিতে কামাই বাড়ানোর ধান্দায় বায়ার নামকাওয়াস্তে এ ক্লিনিক খুলেছে।

অপরদিকে কৃষি সম্পসারণ বিভাগের এ প্ল্যান্ট ডক্টর ক্লিনিক নিয়ে আশাবাদী এলাকার চাষীরা। কলাচাষী নুরুল ইসলাম জানান, ‘ভাইরে মানুষের অসুখ অইলে ডাক্তার পাওয়া যায়, পশুর জন্য ও ডাক্তার আছে। কিন্তু যে উদ্ভিদ না থাকলি দুনিয়া থাকবোনা হের জন্নি কোনো ডাক্তার নাইকা। এইবার তা চালু অইলো। এহন থিকা ক্ষেতে পোঁকা নাগলে, কোনো ব্যারাম অইলে উদ্ভিদের হাসপাতালে আসমু আর সঠিক চিকিৎসা নিমু।’

এ ব্যাপারে মধুপুর উপজেলা কৃষি অফিসার ড. হযরত আলী জানান, জার্মানীর ফ্রাঙ্কফুটে বিশ্বখ্যাত উদ্ভিদ হাসপাতাল রয়েছে। উন্নত দেশে এ নিয়ে উন্নত মানের চিকিৎসা ও গবেষণা হয়। আমাদের দেশে এটি নতুন ভাবনা। এ পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কর্মীরা মাঠপর্যায়ে ইতিবাচক সুযোগ পাচ্ছেন। কৃষকরা ক্লিনিকে স্যাম্বল নিয়ে আসবেন। পরিবীক্ষণ করে ব্যবস্থাপত্র দেয়া হবে। এতে ক্ষতিকারক, চোরাই বা ভেজাল বিষ ব্যবহারের সুযোগ কমবে। বিষের ক্ষতিকারক প্রয়োগ বন্ধ হবে। পরিবেশ বিনষ্টের প্রবনতা হ্রাস পাবে। বড় কথা তৃণমূল পর্যায়ে কৃষকের সাথে কৃষিবিদদের সেতুবন্ধন তৈরি হবে।
//এআরএইচ//

Leave A Reply

Your email address will not be published.