কৃষিখবর ডেস্ক : খরার কবলে ধ্বংসের মুখে আফগানিস্তানের কৃষি। ফসল হারিয়ে দিশেহারা দেশটির কৃষকরা। চরম খাদ্য সংকটে নিজের সন্তানকেও বিক্রি করছেন দেশটির চাষীরা। এই খরা যুদ্ধ পরিস্থিতিকে হার মানাচ্ছে।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিস্তানে বিভিন্ন অঞ্চলে খরার কারণে চাষাবাদ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রচণ্ড খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। দেশটিতে এখন যুদ্ধের চেয়ে খরায় অনেক বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
এ বছর দেশটির পশ্চিমাঞ্চলে দুই লাখ ৭৫ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়েছে। তাদের মধ্যে ৫২ হাজার মানুষ সংঘাতের কারণে এবং বাকি প্রায় সোয়া দুই লাখ মানুষ খরার কারণে বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।
জাতিসংঘ ও বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশটির কয়েকটি অঞ্চলে জমিতে বপণ করার মত বীজ কৃষকদের কাছে নেই। চরম খাদ্যাভাবে সেখানে মানুষ মরতে শুরু করেছে।
আফগানিস্তানে প্রায় দুই কোটি মানুষ কৃষক। কিন্তু খরার কারণে এ বছর প্রায় অর্ধেক জমিতে চাষাবাদ করা সম্ভব হয়নি বলে জানায় দেশটির কৃষি মন্ত্রণালয়।
গত ৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়ের নিয়মিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দীর্ঘদিনের খরার কারণে খাবার না থাকায় গত এক সপ্তাহে বাদগিস প্রদেশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার মানুষ গ্রাম থেকে কালা-ই-নাউ শহরে এসেছে। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে প্রদেশটিতে ভয়াবহ খরা চলছে।
জাতিসংঘের অন্য একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মাসে একই কারণে এক লাখের বেশি মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে হেরাত নগরীতে আশ্রয় নিয়েছে।
খরা পীড়িত প্রায় ৭০ হাজার মানুষ আগে থেকেই কালা-ই-নাউ শহরে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের মানবিক ত্রাণের যোগান দিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। নতুন করে আরো লক্ষাধিক মানুষ আসায় সেখানকার মানবিক পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে বলে শঙ্কা বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থার। প্রদেশটি দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
দ্য ফেমিন আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেমস নেটওয়ার্ক (এফইডব্লিউএস নেট) এর প্রতিবেদনে বলা হয়, আফগানিস্তানে খাদ্যসংকট ‘অস্বাভাবিক রকম বেশি। সেখানে এখন তৃতীয় পর্যায়ের খাদ্যসংকট চলছে। চতুর্থ পর্যায়ে জরুরি অবস্থা এবং পঞ্চম পর্যায়ে পৌঁছালে দুর্ভিক্ষ বলে ধরা হয়।
সাধারণত এই সময় কৃষক ফসল ঘরে তোলা শুরু করে বলে দেশটিতে খাদ্য সংকট এমনিতেই কমে যায়। কিন্তু খরার কারণে চাষাবাদ সম্ভব না হওয়ায় বিশেষ করে বাদগিস ও ফারিয়াব প্রদেশে চরম খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে বলে জানায় সংস্থাটি।
দুর্ভিক্ষের কবলে আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের শহর হেরাতের অধিবাসীরা। কয়েক বছরের নজিরবিহীন খরায় সৃষ্টি হয়েছে এ দুর্ভিক্ষ। পরিবারের সদস্যদের দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের ব্যবস্থা করতে পারছে না পরিবারগুলো। বাধ্য হয়ে এলাকা ছেড়েছে বেশিরভাগ মানুষ। খাবার কেনার জন্য নিজের সন্তান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে বাবা-মায়েরা। এমন বেশ কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে আফগান দুর্ভিক্ষের এক করুণ চিত্র তুলে ধরেছে সিএনএন।
জাতিসংঘের মতে, তীব্র খরায় ২০১৮ সালেই ঘরবাড়ি ছেড়েছেন অন্তত ২ লাখ ৭৫ হাজার মানুষ। এদের মধ্যে পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর হেরাত থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ৮৪ হাজার এবং বাদঘিছ এলাকার ১ লাখ ৮২ হাজার। এ বছর দেশটিতে চলমান সহিংসতায়ও এত মানুষ ঘরহারা হয়নি। টানা চার বছর অনাবৃষ্টির কারণে এই অঞ্চলগুলোর কৃষি খাত চরম সংকটে পড়েছে।
২০১৭ সালে আফিমের উৎপাদন রেকর্ড মাত্রায় হলেও এ বছরে তা কমে গেছে এক-তৃতীয়াংশ। হেরাত শহরের বাইরে একটি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন অনেকেই। সেই হতভাগ্যদের একজন মামারিন। যুদ্ধে স্বামী হারিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তনে হারিয়েছেন ঘর।
পরিবারের অন্য সন্তানদের মুখেও একটু খাবার তুলে দিতে হারিয়েছেন এক সন্তানকে। মাত্র ৩ হাজার ডলারের বিনিময়ে ছয় বছরের মেয়ে আকিলাকে বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি। ক্ষুধার জ্বালা থেকে বাঁচতে এ ছাড়া তার সামনে ‘আর কোনো পথই খোলা’ ছিল না বলে জানিয়েছেন তিনি। মামারিন বলেন, ‘খরার কারণে আমি তিন সন্তান নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে আসি। এখানে এসেছিলাম সহযোগিতা পাওয়ার আশায়। কিন্তু কিছুই পেলাম না। সন্তানসহ না খেয়ে মৃত্যু এড়াতে আকিলাকে এক ব্যক্তির কাছে ৩ হাজার ডলারের বিনিময়ে দিয়ে দিই। কিন্তু আমি পেয়েছি মাত্র ৭০ ডলার।
//এআরএইচ//