কৃষিখবর প্রতিবেদক : দেশের খাদ্য ভান্ডার হিসাবে পরিচিত উত্তরাঞ্চলে এখন সবুজের সমারোহ। বছরজুড়েই আবাদ হচ্ছে নানা ফসল। শুষ্ক মাটির বরেন্দ্র অঞ্চলে বছরে একবার ধান নির্ভর ভূমি এখন বহুমুখি শষ্য আবাদের জমিতে পরিণত হয়েছে। এ অঞ্চলে শষ্য আবাদে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। যেসব জমিতে ধান (বৃষ্টি নির্ভর) ছাড়া অন্যকিছু চাষাবাদ কল্পনাই করা যেত না।
সে জমিতে এখন সারা বছর আবাদ হয়। মওসুম অনুযায়ী জমিতে গমের সোনালী শীষ, সরিষার হলুদ চাদর, আমন, বোরো-আউসের সবুজতা, পাট, আলু, টমেটো, গাজরের সোনালী আভা
উত্তরাঞ্চলের কৃষকের হৃদয় দোলায়। বাধাকপির সবুজবল আর ফুলকপির সফেদ উজ্জল ফুল, মাচায় মাচায় ঝুলন্ত লাউ কুমড়ো সীম বরবটি, পটল, ঝিঙ্গে, ঢেড়স, বেগুন, মূলা ক্ষেতের নজরকাড়া দৃশ্য দু’চোখে স্বপ্নের আল্পনা আাঁকে। ফসলের সাথে মিতালী করেই কিষান কিষানীর সুখ স্বপ্নের বার মাস কাটছে। এক ফসলা জমিতে এখন বছরজুড়েই হচ্ছে আবাদ। মাঠ ভরা এত ফসল। কৃষকের এত ব্যাস্ততা তারপরও মাঝে মাঝে তাদের মন খারাপ হয়। ঘাম ঝরিয়ে ভাল ফলন ফলিয়ে তারা কখনো উৎপাদিত পন্যের নায্যদাম পায়, আবার কথনো পায়না।
যারা আগাম কিছু শাকসবজী আবাদ করে তারা ভাল দাম পেলেও ফসল ওঠার ভরা মওসুমে একেবারে দাম পড়ে যায়। উৎপাদন খরচতো দূরে থাক নিজের শ্রম ঘামের মূল্য তখন জোটেনা। হাট বাজারে তরিতকারীর দাম কিছুটা কম হবার কারনে সাধারন ভোক্তারা সাময়িক স্বস্তি পেলেও মাঠে এর উল্টো প্রভাব পড়ে। মওসুমের শেষ দিকে এসে অবস্থা এমন এসে দাড়ায় যে মাঠ পরিস্কারের মজুরীও ওঠেনা। ক্ষেতের ফসল ক্ষেতেই পঁচে। অনেক সময় কপি, মুলা, টমেটো, আলু, গরু ছাগল আর মাছের খামারে খাদ্যও হয়। খেতে খেতে গরু ছাগলের অরুচি হয়। প্রায় বছরই কৃষককে এমন লোকসানের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আমন বোরো ধানের নায্য দাম কখনোই প্রান্তিক চাষীর কপালে জোটেনি।
অন্যের জমি বর্গা আর ভাড়া নিয়ে ধারদেনা করে ঘাম ঝরিয়ে কৃষক আবাদ করছে। স্বপ্ন দেখছে ঘুরে দাঁড়াবার। কিন্তু বার বার সে স্বপ্ন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। ঘাম ঝরানো ফসলের এমন বেহাল দশা দেখে গুমরে কাঁদছে। তাদের ঋনের বোঝা দিন দিন বেড়েই চলছে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে আর নয় কৃষি। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত বার বার পাল্টাচ্ছে। কোন উপায় নেই। কৃষি যে তাদের ধ্যান জ্ঞান। যত কষ্ট হোক মাটি যে তাদের ডাকে। সে ডাক উপেক্ষা করতে পারেনা।
রোদে পুড়ে ঘাম ঝরিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে মাটিতে ফসল ফলানোর মধ্যে তাদের আনন্দ সুখ স্বপ্ন। কৃষি বিষয়ক প্রতিবেদন করার জন্য। সম্প্রতি বরেন্দ্র অঞ্চল সরেজমিন পর্যবেক্ষন করে আর কৃষকসহ সংশ্লিষ্টজনদের সাথে আলাপ করে যে চিত্রটি পাওয়া যায় সার্বিক ভাবে প্রান্তিক চাষীরা ভাল নেই। অথচ এরাই কৃষির প্রাণ। সবে শেষ হয়েছে শীতকালীন শাকসকজীর মওসুম। এখন চলছে গ্রীস্মকালীন ফসলের আবাদ। মাঠজুড়ে বোরোর সবুজ-সোনালী প্রান্তর। গ্রীষ্মের খরতাপে মাটিতে টান ধরে। প্রয়োজন হয় সেচের। এবার ক’দিন ভাল বৃষ্টি হওয়ায় রুক্ষ আবহাওয়া কিছুটা শীতল আর জমিতে পানি জমায় প্রাণ পেয়েছে বোরোধানেরের ক্ষেত। মাইলজুড়ে বাতাসে ঢেউ খেলানোর দোলার দৃশ্য মনেও দোলা দেয়।
বিশাল বোরোর ক্ষেতের যতœআত্তি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে কজন চাষী বিশ্রামের জন্য বসেছিলেন আমতলায়। লাহারী নিয়ে (দুপুরের খাবার)। মাসকালাইয়ের রুটির সাথে পিয়াজ মরিচের মিশ্রনের ঝাল। খানিকটা গুড়ও দেখা গেল। বললাম পান্তা কই ? একজন রেগে গিয়ে বললেন পঞ্চাশ ষাট টাকা কেজি চাল। আর পান্তা খাওয়া। এখনতো ওসব আপনারা ঢং করে খান বছরের একদিন।
আবাদর অবস্থা জানতে চাইলে গোল হয়ে বসে থাকা ছয়জনের একজন জানালেন জমির মালিক থাকে শহরে। দশ বিঘা জমি আবাদের জন্য এক বছরের জন্য লীজ নিয়েছেন। প্রতি বিঘার ভাড়া হলো সাত হাজার টাকা। জমি চাষ থেকে সার বীজ সেচ মজুরের মজুরী সব খরচ তার। সাথে পাশেই নিজের জমি রয়েছে তিন বিঘা। চালের বাজার চড়া হলেও বিগত আমন আবাদের প্রান্তিক চাষীরা ভাল দাম পায়নি। আর কখনো যায়ও না।
ধান কাটার সাথে সাথে ফড়িয়া আর সুদী মহাজনের লোকজন খুব কম ধরে ফসল নিয়ে যায়। অন্যান্য ফসলের দামও ফড়িয়াদের নিয়ন্ত্রনে থাকে। যার ফলে ঘাম ঝরানো কোন ফসলেরই নায্যদাম পায়না আবাদকারীরা। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে লোকসান গুনতে হয়। পবার তেঘর গ্রামের কৃষক লুৎফর জানান এবারো তারা আলুতে লোকসান দিয়েছেন। গতবার লোকসানের কারনে যদিও এবার আলু আবাদের জমির পরিমান কমছে। আবহাওয়া অনুকুল থাকায় এবারো আলুর ফলন ভাল হয়েছে। আর এই ভাল ফলনই কাল হয়েছে। মাঠ থেকে তাদের আলু বিক্রি করতে হয়েছে প্রকার ভেদে পাঁচ ছয় টাকা কেজি। যাতে উৎপাদন খরচই উঠা দায় হয়েছে।
আলু ব্যবসায়ী সাহেব বাজারে তুহিন জানান গতবার হিমাগার আলু রেখে কয়েক লাখ টাকা লোকসান গুনেছেন। এবারো কমদামে আলু কিনে হিমাগারে রেখেছেন। এখনি আলুর বাজার চড়তে শুরু করেছে। লাভের প্রত্যাশা তার। কিন্তু উৎপাদকের লাভতো দূরে থাক উৎপাদনের খরচে লোকসান রয়ে গেল। শুধু আলু নয় সব ফসলেই এমন লোকসান গুনতে হচ্ছে। লাভ হচ্ছে বড় বড় জোতদার মিল মালিক হিমাগার মালিক আর ফড়িয়া ব্যবাসয়ীদের। ক্রেতাদের পকেট কাটা কম যাচ্ছে না।
প্রান্তিক চাষীরা ঘাম ঝরিয়ে ফসল উৎপাদন করে খাদ্যের যোগান দিলেও এদের ভাগ্যে কখনো সরকারী সুযোগ সুবিধা জোটে না। ব্যাংক ঋণ , সরকারী প্রনোদনা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা মেলে জমির মালকানার কাগজ দেখে। অনেক জোতদার বর্গা দেয়া জমির ফসল দেখিয়ে ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদের কৃষি ঋণ নিয়ে অন্য ব্যবসাতে লাগায়।
আবার স্বল্প জমির মালিকরা ঋণ নিতে গিয়ে পড়ে নানা বিড়ম্বনায়। একজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন ত্রিশ হাজার টাকার ঋণ নিতে গিয়ে ক’দিন ঘুরতে হয়েছে। আবার হাজার পাঁচেক টাকা খরচও হয়েছে। তারপর সুদ রয়েছে। এসব ঝক্কি ঝামেলা এড়াতে বাধ্য হয়ে দারস্থ হতে হয় মুখিয়ে থাকা সুদি মহাজন আর এনজিও গুলো। এনজিও সেবার নামে পুরো দস্তুর ব্যবসা করে এমন অভিযোগ পথে প্রান্তরে।
সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কেউ কেউ বেশ ক্ষোভের সাথে বলেন মাঠ ভরা ফসল দেখে আপনারা পেপারে লিখে আর টিভিতে ছবি দেখিয়ে সব ভাল দ্যাখেন। কিন্তু এর পেছনের মানুষ গুলোর কান্না শোনার যেন কেউ নেই। শেয়ার বাজার, ব্যাংক ধ্বসের চেয়ে বড় ধ্বস নামছে কৃষিতে। কৃষি ধস নিয়ে কখনই হৈ চৈ হয়না। বাজারে সব কিছুর দাম আছে। শুধু দাম নেই প্রান্তিক চাষীর ঘাম ঝরানো ফসলের।
কৃষি বিশেষজ্ঞ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন কৃষিতে ক্রমাগত লোকসান চলতে থাকলে কৃষক আবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। অপ্রতুল এবং অপরিকল্পিত বিপনন ব্যবস্থার কারনে অনেক ক্ষেত্রেই কৃষক তার পন্যের নায্য দাম পাচ্ছে না। বিপনন ব্যবস্থার আশুউন্নতি না ঘটলে কৃষিতে বিপর্যয় ঘটবে। চাষাবাদে ধ্বস নামলে দেশ পড়বে চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায়। ভাল ফলন নিয়ে আত্মতৃপ্তি নয়। এর পেছনের মানুষ গুলোকে বাঁচাতে হবে।
কৃষির দেখভালের জন্য কৃষি সম্প্রসানর বিভাগ রয়েছে। তারা আবাদের পরিমান নির্ধারন আর পরামর্শেই দায়িত্ব শেষ করছে। অন্যদিকে বাজার মনিটরিং দপ্তর নামে একটি অফিস রয়েছে। মনিটরিং বিভাগের কাজ হলো প্রতিদিনের বাজার দর কেন্দ্রে পাঠানোর।
//এআরএইচ//