Ultimate magazine theme for WordPress.

নাগরিক পরিবেশ এবং ছাদ বাগান

0


মাহবুবা আকতার
ইট পাথরের শহরে পর্যাপ্ত গাছ-গাছালী নেই। নেই সবুজের চিহ্ন। ফলে বাড়ছে অক্সিজেনের অভাব। অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণে দুষিত হচ্ছে পরিবেশ। বাড়ছে তাপমাত্রা। জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় ভুমিকা রাখতে পারে ছাদ বাগান। নগরবাসীর অক্সিজেনের ভান্ডার হতে পারে ছাদ বাগান। একই সঙ্গে সারা বছরের শাক সবজির যোগান হতে পারে বাড়ির ছাদ থেকে।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন কারণ রয়েছে, যেমন- অধিক জনসংখ্যা, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ, বন উজাড়, নগরায়ণ, ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা ইত্যাদি। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে শহরাঞ্চলের তাপমাত্রা গ্রামাঞ্চলের তুলনায় অধিক বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা শহরে তাপ দ্বীপ সৃষ্টি করছে। এতে পরিবেশের ক্ষতি হয়ে মানুষের মারাত্মক রোগব্যাধি ও অকালমৃত্যু হচ্ছে।

আমরা সবাই জানি, গাছপালা পরিবেশ উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখে। গাছ পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধিকারক কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং প্রাণিকুলের জন্য অক্সিজেন নিঃসরণের মাধ্যমে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি বিশ্বে বহুল আলোচিত বিষয়। ধারণা করা হয়, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সঠিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে এ বিশ্বের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। মহাবিশ্বে একমাত্র পৃথিবীতেই রয়েছে মানুষ ও অন্যান্য জীবের বসবাসের উপযোগী পরিবেশ। এখন সময় এসেছে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীবকুলকে যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন করা। মূলত উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নামে দেশে দেশে প্রাকৃতিক সম্পদের অপরিমিত ও যথেচ্ছ ব্যবহার এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিকারী গ্রিনহাউস গ্যাসের ব্যাপক নির্গমন আজকের এ ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

বিশ্বে জনসংখ্যার শতকরা ৩৪ ভাগের বেশি মানুষ ২০৩০ সালের মধ্যে শহরে বসবাস করবে। এতে বাসস্থান ও অন্যান্য কাজে ব্যবহারের কারণে বহু ফসলি জমি হারিয়ে যাবে এবং পরিবেশ ও জলবায়ু হুমকির সম্মুখীন হবে। এতে পৃথিবীতে প্রজাতির বিলুপ্তি, স্থান পরিবর্তন ও মানুষের সুষ্ঠু জীবনধারণের সুযোগ-সুবিধা অনেকাংশে কমে যাবে।

গাছ লাগানো বা বাগান করা এমন একটি উপায়, যা শুধু পরিবেশ উন্নয়নের নিয়ামকই নয়; খাবার, আশ্রয়, ওষুধ ইত্যাদি নিয়ামক সরবরাহ করে, পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সহায়তা করে। অবকাঠামো তৈরিতে যে পরিমাণ চাষের জমি নষ্ট হয়, ছাদে বাগানের মাধ্যমে তার কিছুটা হলেও ঘাটতি পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই গড়ে তুলুন পরিবেশ-সহায়ক ছাদে বাগান আর নিশ্চিত করুন পরিবারের জন্য বিষমুক্ত সবজির জোগান।

ছাদ-বাগান হলো, মানবসৃষ্ট সবুজ আচ্ছাদান- যা টবে, ড্রামে, রোপণকৃত গাছ যে কোনো আবাসিক, বাণিজ্যিক বা কলকারখানার ছাদে করা হয়ে থাকে। আমরা গ্রামাঞ্চলে সাধারণত বিভিন্ন স্থানে বাগান করে থাকি, যেমন- বাড়ির আঙিনায়, রাস্তার পাশে, মাঠে ও অন্যান্য জায়গায়। কিন্তু শহর এলাকায় এ ধরনের বাগান করার পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় ছাদে বাগান করে এ সীমাবদ্ধতা পুষিয়ে নেয়া সম্ভব।

ছাদে বাগান কার্যক্রমের আওতায় নগরের পরিবেশগত বর্তমান সমস্যা অনেকাংশে দূর করা সম্ভব, পাশাপাশি সম্ভব বাড়তি খাদ্য, পুষ্টি ও অর্থ উপার্জন। বহির্বিশ্বের মানুষ অনেক আগে থেকেই ছাদে বাগান করে আসছে।

বাংলাদেশ সরকারও এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর এ ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে অপরিকল্পিতভাবে অল্পসংখ্যক ছাদ-বাগান করা হলেও তা ব্যাপকতা লাভ করেনি।

ছাদে বাগান করে শহরে গাছপালা প্রবর্ধনের মাধ্যমে জীবের জন্য নিরাপদ পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব। ছাদের বাগানের উদ্দেশ্য হচ্ছে শহরাঞ্চলের বাতাসের গুণাগুণ উন্নয়ন করা। কারণ গাছপালা হচ্ছে পরিবেশের বিষাক্ত উপাদানের প্রাকৃতিক ছাঁকনি।

ছাদে ফুলফল, শাকসবজি, মশলা প্রভৃতি চাষাবাদে সুশীতল ছায়া ও পশুপাখির আশ্রয় স্থান নিশ্চিত করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুর তাপমাত্রা বৃদ্ধির উপাদান, যেমন- পার্টিকুলেট ম্যাটার গাছের পাতা, কা- ও শাখায় লেগে থাকে বা পরবর্তীকালে সেচ ও বৃদ্ধির পানির মাধ্যমে মাটিতে চলে যায়। ফলে বায়ুর তাপমাত্রা হ্রাস পায়। এছাড়া গাছপালা গ্রীষ্ম তাপ শোষণ ও শীতকালে বর্জন করে শহরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।

গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়ার কবল থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এ ছাদ-বাগানের মাধ্যমে। একই সঙ্গে পরিবেশ সুশীতল ও শান্তিময় থাকে। সর্বোপরি বাড়ির শিশুরা বিষমুক্ত ফল ও শাকসবজি খেতে পারে।
গবেষণায় পাওয়া যায়, ছাদের বাগান বাইরের তাপমাত্রার চেয়ে ঘরের ভেতরের তাপমাত্রা প্রায় ১.৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস হ্রাস করতে পারে, যা শীতলীকরণ চাহিদার জন্য বিদ্যুৎ খরচ কমায় এবং ছাদ-বাগানে ছাদের তাপমাত্রা ও ছাদ-বাগানবিহীন ছাদের তাপমাত্রার পার্থক্য ৭.৮৬ সেলসিয়াস হয়।

ছাদে বাগান বৃদ্ধির ফলে পানি ধরে রাখা শহরে কৃষি সম্প্রসারণ তথা ফুলফল-শাকসবজির চাহিদা পূরণ, আয়ের উৎস, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। এটি সামাজিক সম্পর্ক শিক্ষা গবেষণা এবং খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যমে শহরে কৃষির একটি মডেল হতে পারে।

পরিকল্পিতভাবে উদ্যোগ নেয়া হলে বাড়ির ছাদে যে কোনো গাছ, এমনকি শাকসবজি ফলানো সম্ভব। আঙুর, বেদানা, ডালিম, আমড়া, পেয়ারা ইত্যাদি মৌসুমি ফল ছাড়াও কলমিশাক, কলা, ডাঁটা, লাউ ইত্যাদি অনায়াসে উৎপাদন করা যায়।

ছাদ-বাগানের প্রয়োজনীয়তা : গ্রিনহাউস গ্যাস শোষণ ও অক্সিজেন নির্গমনের মাধ্যমে নির্মল পরিবেশ নিশ্চিত হবে। এছাড়া রাসায়নিক বিষমুক্ত যে টাটকা শাকসবজি ও ফলমূল পাওয়া যাবে, সেটি আপনার পরিবারের লোকজন, বিশেষ করে শিশুরা নির্ভয়ে খেতে পারবে। শহরে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য অথবা দৈনন্দিন প্রয়োজনে আপনি পরিবেশের দূষণ ঘটিয়ে যাচ্ছেন।

প্রকৃতির কাছে আপনি দায়বদ্ধ। আপনার কাজের মাধ্যমে সে দায় কতটুকু মেটাতে পেরেছেন? বাগান করার মাধ্যমে আপনি কিছুটা হলেও দায়মুক্ত হতে পারেন। এছাড়া পরিবেশ রক্ষা, দূষণ রোধে ও সৌন্দর্য বর্ধনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে এ ছাদ-বাগান।

ছাদে চাষের উপযোগী গাছ : আজকাল বিভিন্ন নার্সারিতে বেঁটে জাতের ফলের চারা পাওয়া যায়, যা ছাদে চাষ করার জন্য উপযোগী। আমরা ক্ষেত-খামারে যেসব শাকসবজি, ফলফুল ও বাহারি গাছের চাষ করে থাকি, তার প্রায় সবই ছাদে চাষ করা যায়। তবে বিশেষ বিশেষ প্রজাতির গাছ ছাদে চাষ করার জন্য অধিক উপযোগী। সাধারণত যেসব প্রজাতির গাছ বা ফসল ছাদে চাষ করা যেতে পারে, সেসবের মধ্যে ফুলজাতীয় গোলাপ, গাঁদা, ডালিয়া, বেলি, রজনিগন্ধা, নয়নতারা, অফিস ফুল, চন্দ্রমল্লিকা, জারবেরা, অর্কিড, ক্যাকটাস, রঙ্গন, চাইনিজ পাম, ক্যাবেজ পামসহ বাহারি গাছের চাষ করা যেতে পারে। শাকসবজির মধ্যে টমেটো, শিম, কপি, পালংশাক, বেগুন, ঝিঙা, মরিচ, কলমিশাক, পুঁইশাক, লেটুস, পেঁয়াজ, করলা, বরবটি, রসুন, শসা, ধুন্দল, বিলাতি ধনে ইত্যাদি সবই চাষ করা যেতে পারে। ফলের মধ্যে আম, পেয়ারা, আমড়া, লেবু, কুল, জামরুল, কমলা, স্ট্রবেরি, ডালিম, মাল্টা, করমচা, বাতাবি লেবু, সফেদা, আঙুর, কামরাঙা ইত্যাদি ফলের চাষ করা যেতে পারে।

ছাদে বাগান সৃজনের পদ্ধতি : গাছ লাগানোর টব, ড্রাম বা পাত্র : ছাদে যেহেতু মাটি নেই, তাই সেখানে পাকা হাউস, কাঠের স্ট্রাকচার, হাফ ড্রাম, টব, রঙের ড্রাম, বালতি, পানি বা সয়াবিন তেলের প্লাস্টিক বোতল ইত্যাদি পাত্রে জৈব সারসমৃদ্ধ মাটি ভরাট করে সেখানে গাছ জন্মানো হয়। প্লাস্টিক বা মোটা কাপড়ের ব্যাগেও গাছ লাগানো যেতে পারে। গাছের আকার অনুসারে টবের আকার ছোট-বড় হতে পারে।

মোটকথা, এসব ব্যক্তির উদ্ভাবনী চিন্তা, অভিজ্ঞতা, উপকরণের প্রাপ্যতা, সামর্থ্য ইত্যাদির ওপর নির্ভর করবে। অন্যদিকে যারা ভাড়া বাসায় থাকেন অথবা একটি ফ্ল্যাটের মালিক, ছাদে বাগান করার সুযোগ নেই, তারা তাদের ব্যালকনিতেই ক্ষুদ্র পরিসরে সুন্দর বাগান গড়ে তুলতে পারেন।

  • লেখক : উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা, উত্তরা মেট্রোপলিটন কৃষি অফিস, ঢাকা।

Leave A Reply

Your email address will not be published.