মোহাম্মদ আতিকুর রহমান হাবিব : তীব্র শীতে কাঁপছে দেশ। নাকাল জনজীবন। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জমির ফসল। উদ্বিগ্ন কৃষকরা। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বোরো ধানের বীজতলা। ক্ষতির মুখে আলু, ডাল, তৈলবীজ জাতীয় ফসলসহ মাঠের শীতকালীন বেশ কিছু ফসল। আবার অনেক স্থানে আগাম জাতের আমের মুকুলও ঝরে যাচ্ছে। সারাদেশে সার্বক্ষনিক সহযোগিতা দিচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তাৎক্ষণিকভাবে ফসল রক্ষায় বাড়তি যত্ম ও ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন কৃষি কর্মকর্তারা। তীব্র শীত বা শৈত্যপ্রবাহে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি রোধে কৃষকদের সাবধান থাকার পরামর্শ দিয়েছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। শীতে ফসল রক্ষায় ৭টি পরামর্শ দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
কয়েকদিন ধরে তীব্র শীতের সঙ্গে রংপুর বিভাগের সব জেলা, রাজশাহী, পাবনা, নওগাঁ, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ কয়েকটি জেলায় বইছে শৈত্যপ্রবাহ। প্রচÐ ঠান্ডায় শীতকালীন শাকসবজি ও ফসলে পোকার আক্রমণ বেড়েছে। এছাড়া পান হলদে হয়ে ঝরে যাচ্ছে। শীতে বীজতলা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় বোরো রোপণে বিলম্ব হচ্ছে। এতে আমাদের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। পানের ক্ষতি হলে পুঁজি হারিয়ে পথে বসে যেতে হবে।
তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে আলু, ডাল ও তেল জাতীয় ফসল চাষ হয়। এছাড়া তৈরি করা হয় বোরো ধানের বীজতলা। রাতের তাপমাত্রা যখন ২০ ডিগ্রির নিচে চলে আসে ও কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ার জন্য আর্দ্রতা ৮০ বা ৯০ পারসেন্ট হয়ে যায় তখন শীতকালীন ফসলে বিভিন্ন রোগের আক্রমণ হয়।
সারা দেশব্যাপী নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে মে মাস পর্যন্ত বোরো ধানের মৌসুম চলে। এ সময় বীজতলায় বীজ বপন করা হয়। কয়েকদিনের প্রচন্ড শীত ও ঘন কুয়াশায় ক্ষতি হচ্ছে বোরো ধানের বীজতলা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোসাম্মৎ সালমা পারভীন বলেন, সপ্তাহব্যাপী তীব্র শৈত্যপ্রবাহের কারণে বীজতলায় থাকা চারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রির নিচে চলে গেলে ধানের চারাগাছ হলুদ হয়ে যেতে পারে, তখন তা খাদ্য তৈরি করতে পারবে না। চারা মরে যেতে পারে। চারা যাতে মরে না যায় সেজন্য স্বচ্ছ সাদা পলিথিন দিয়ে বাঁশের মাচার মতো তৈরি করে বীজতলা ঢেকে রাখার পরামর্শ দিচ্ছি আমরা।
শীতে ঝরে পড়ছে সরিষার ফুল। সকাল থেকে কুয়াশায় মোড়ানো থাকছে চারপাশ। এতে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। রাতে ফসলে কুয়াশা পড়ে। ভোরে মাঠে গিয়ে সেসব কুয়াশা সরিয়ে দিতে হয়। আবার অনেক এলাকায় বোরোর বীজতলা পলিথিন দিয়ে ঢেকে কুয়াশা রোধ করতে হচ্ছে। এর জন্য উৎপাদন খরচ বাড়ছে। শীতের এই সময়ে কুয়াশার কারণে বোরো ধানের বীজতলায় লালচে রং হয়ে যায়।
শৈত্যপ্রবাহের কারণে বীজতলার চারা হলুদ বা ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণের আশঙ্কা রয়েছে। তাই কৃষকদের বীজতলা রক্ষায় প্রতি শতাংশ জমিতে ২৮০ গ্রাম ইউরিয়া ও জিপসাম ৪০০ গ্রাম দিতে হবে। সম্ভব হলে রাতের বেলা পানি দিয়ে বীজতলা ঢেকে রাখতে হবে। সকালে পানি বের করে দিতে হবে।
তীব্র শীতে ফসল রক্ষায় চার ধরনের নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। কুয়াশা ও তীব্র শীতের এ অবস্থায় ফসলের বীজতলায় ৩-৫ সেন্টিমিটার পানি ধরে রাখতে হবে। স্বচ্ছ পলিথিনের ছাউনি দিয়ে বীজতলা দিনরাত ঢেকে রাখতে হবে, তবে খেয়াল করতে হবে চারার পাতা যাতে পলিথিন স্পর্শ না করে।
পাশাপাশি ঢেকে রাখা বীজতলায় পানি সকালে বের করে দিয়ে আবার নতুন পানি দিতে হবে, সঙ্গে চারার ওপর জমে থাকা শিশির ঝরিয়ে দিতে হবে। আর প্রতি দশ লিটার পানিতে ৭০-৮০ গ্রাম থিওভিট অথবা কমুলাস ভালোভাবে মিশিয়ে ৪-৫ শতাংশ বীজতলায় স্প্রে করতে হবে।
পাঁচ একর জমিতে আলু, বেগুন, সরিষা, লাল শাক, চিয়া সিডসহ শীতের বিভিন্ন সবজি চাষ করেছেন বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জে সিরাজদিখান উপজেলার কৃষক মো. বিল্লাল হোসেন মোল্লা। তিনি জানান, কিছুদিন আগে বৃষ্টিতে আলুর বেশ ক্ষতি হয়েছে। এখন আবার তীব্র শীতের কারণে ফসল নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন রয়েছেন। শীতে আলুতে আর কোনও ঝামেলা যাতে না হয় সেজন্য কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে নিয়মিত ওষুধ স্প্রে করছেন তিনি।
কুয়াশাযুক্ত আবহাওয়ায় মড়ক রোগে আক্রান্ত আলু গাছ দ্রæত লতাপাতা ও কাÐসহ পচে যায়। দুই-তিনদিনের মধ্যেই মাঠের সমস্ত গাছই মরে যেতে পারে। আলুক্ষেতের পচন রোগ থেকে বাঁচার জন্য সার ও কীটনাশকের পাশাপাশি ছত্রাকনাশক স্প্র্রে করতে হবে।
শিমে একধরনের মরিচা রোগ হয়। এমন আবহাওয়ায় এই রোগ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে।
তাপমাত্রা আরো নেমে গেলে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় মসুর ডাল। ‘স্কোলোরোশিয়াম রলফছি’ নামের ছত্রাকের আক্রমণে মসুর গাছ গোড়া পচা রোগে আক্রান্ত হয়। তাই রোগের আক্রমণ এড়াতে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ফসলহানির ব্যাপক আশঙ্কা থাকে। মসুর ডালে গোড়া পচা রোগ দমনে অটোস্টির-৫০ ডাবি¬উ পি নামে ওষুধটি প্রতি লিটার পানিতে দশমিক দুই গ্রাম মিশিয়ে সাত থেকে দশদিন পরপর দুই -তিনবার গাছের গোড়া ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি থেকে ১৮ ডিগ্রি ও আর্দ্রতা ৮০ থেকে ৯০ পারসেন্ট হলে সরিষাতে কান্ড পচা রোগ দেখা দেয়। এ রকম আবহাওয়ায় যদি এ রোগ দেখা দেয় তাহলে ধ্বংসাত্মক অবস্থা দেখা দেয়। কাÐ পচা রোগ দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতি লিটার পানিতে রোভরাল দুই গ্রাম মিশিয়ে তিনবার ফসলে স্প্রে করার পরামর্শ দিয়েছে কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত¡ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. বেলাল হোসেন বলেন, এই সময় বিশেষ করে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি, আলু, টমেটো, বেগুন, শিমের চাষাবাদ হচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিষয়-বোরো ধানের বীজতলা করা হচ্ছে। পেঁয়াজ আবাদের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। প্রচন্ড শীত ও কুয়াশায় এগুলো সরাসরি হুমকির মুখে পড়েছে।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো. গোলাম মওলা বলেন, প্রচন্ড ঠান্ডার সঙ্গে কুয়াশা থাকায় রবি ফসলের ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে। শীত ও কুয়াশা চলমান থাকলে শীতকালীন শাকসবজি ও বোরো ধানের বীজতলা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া আগাম জাতের আম গাছে আসা মুকুল ঝরে যেতে পারে। সব মিলে ফসল রক্ষায় এখন থেকেই কার্যকর ভূমিকা নিলে কোনো ধরনের সমস্যা হবে না। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, প্রচন্ড শীতের কারণে জীবনযাত্রা কিছুটা হলেও ব্যাহত হচ্ছে। জমি চাষ কাজে কৃষকরা সমস্যায় পড়লেও এখন পর্যন্ত বীজতলার ক্ষতি হয়নি। তবে দ্রুত আবহাওয়ার পরিবর্তন না হলে বোরো চাষ কিছুটা বিঘ্নিত হতে পারে।
তীব্র শীতে কৃষি ফসল রক্ষায় গতকাল বুধবার ৭টি পরামর্শ দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। গতকাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আওতাধীন কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. মো. শাহ কামাল খানের দেয়া কৃষি পূর্বাভাসে জানানো হয়, সারাদেশে তীব্র শীত বিরাজমান। এর পাশাপাশি আগামী তিনদিনের মধ্যে রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগে হালকা বৃষ্টি বা গুঁগিগুঁড়ি বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে এবং এটি কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
এ পরিস্থিতিতে ফসল রক্ষায় বোরো ধানের বীজতলায় ৩-৫ সেন্টিমিটার পানি ধরে রাখতে হবে। ঠান্ডার প্রকোপ থেকে রক্ষা এবং চারার স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য বীজতলা রাতে স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিন। বীজতলা থেকে পানি সকালে বের করে দিয়ে আবার নতুন পানি ি তে হবে। প্রতিদিন সকালে চারার ওপর জমা হওয়া শিশির ঝরিয়ে দিন আবহাওয়ার বর্তমান পরিস্থিতিতে আলুর নাবিধসা রোগের আক্রমণ হতে পারে। প্রতিরোধের জন্য অনুমোদিত মাত্রায় ম্যানকোজেব গোত্রের ছত্রাকনাশক ৭-১০ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।
তিনি জানান, সরিষায় অলটারনারিয়া ব¬াইট রোগ দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুমোদিত মাত্রায় ইপ্রোডিয়ন গোত্রের ছত্রাকনাশক ১০ থেকে ১২ দিন পর পর ৩ থেকে ৪ বার স্প্রে করতে হবে। ঠান্ডাজনিত ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষার জন্য ফল গাছে নিয়মিত হালকা সেচ দিতে হবে। কচি ফল গাছ ঠান্ডা হাওয়া থেকে রক্ষার জন্য খড় বা পলিথিন শিট দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
গম ক্ষেতে যেন পানি জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির ঘর চট বা কালো কাপড় দিয়ে ঘিরে ি তে হবে এবং হাই ভোল্টেজ বাল্ব জ্বালিয়ে রাখতে হবে। এছাড়া নিম্ন তাপমাত্রার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে পুকুরে যেন যথেষ্ট পরিমাণে পানি থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ থেকে মাছ রক্ষার জন্য পুকুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে।