কৃষিখবর ডেস্ক : বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, নগরায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যাপক মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহারের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে পুরো বিশ্বের সমগ্র কীটপতঙ্গের প্রজাতি। সংখ্যায় মানুষের অন্তত ১৭ গুণ বেশি হলেও, একশ বছরের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে কীটপতঙ্গরা।
অস্ট্রেলিয়া ও চীনের দুইটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের যৌথভাবে রচিত এক গবেষণা প্রতিবেদনের সূত্রে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানিয়েছে, বর্তমানে প্রতি বছরে দুই দশমিক পাঁচ শতাংশ হারে বিশ্বে কীটপতঙ্গের সংখ্যা কমছে। কয়েক প্রজাতির প্রজাপতি ও ভ্রমর ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়েও গেছে।
কীটপতঙ্গ রক্ষার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা বলেছেন, পাখি, সরীসৃপ, উভচর প্রাণি এবং মাছের খাদ্য এসব কীটপতঙ্গ। খাদ্যের উৎসই যদি না থাকে তাহলে তারাও বিলুপ্তির দিকে যাবে। ক্রমান্বয়ে এর প্রভাব পড়বে অন্যান্য প্রাণিদের ওপর। গবেষণায় যেসব কীটপতঙ্গের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার ও বিলুপ্ত হওয়ার কথা জানা গেছে তাদের বাইরে মাছি, পিপড়া, ঝিঁঝিঁ পোকাসহ অন্যান্য কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রেও একই রকম অবস্থা হওয়ার কথা। কারণ তারাও চরম প্রতিকূল পরিবেশের শিকার হচ্ছে।
‘বায়োলজিক্যাল কনভার্সেশন’ সাময়িকীতে গবেষণা প্রবন্ধটি লিখেছেন অস্ট্রেলিয়ার ‘ইউনিভার্সিটি অব সিডনির’ ফ্রান্সিস্কো সানচেজ বেও এবং চীনের ‘অ্যাকাডেমি অব এগ্রিকালচারাল সায়েন্সের’ ক্রিস উইকখুইস। সানচেজ বেও মন্তব্য করেছেন, ‘কীটপতঙ্গের বিলুপ্তি হওয়া যদি বন্ধ করা না যায় তাহলে তা পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংস করবে ও মানবজাতির ভবিষ্যতের জন্য মহাবিপর্যয় ডেকে আনবে।’
গত ২৫-৩০ বছরে দুই দশমিক পাঁচ শতাংশ হারে কীটপতঙ্গের সংখ্যা কমতে থাকার বিষয়টিকে ‘ভয়ঙ্কর’ আখ্যা দিয়ে সানচেজ বেও মন্তব্য করেছেন, ‘এটা খুব দ্রুত ঘটছে। আগামী দশ বছরের মধ্যে এক চতুর্থাংশ কীটপতঙ্গ হ্রাস পাবে। আগামী ৫০ বছরে মারা যাবে সমগ্র কীটপতঙ্গ প্রজাতির প্রায় অর্ধেক। ১০০ বছর পর কিছুই থাকবে না।’
বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্তনপায়ী প্রাণিদের বিলুপ্তির বিষয়টি সহজে চোখে পড়ে। কিন্তু দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায় কীটপতঙ্গের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি। বিশ্বের ৪০ শতাংশেরও বেশি কীটপতঙ্গের প্রজাতি দ্রুত সংখ্যাগত দিক থেকে কমছে। এক তৃতীয়াংশকে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার হার স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ ও পাখিদের সংখ্যা হ্রাসের চেয়ে আট গুণ বেশি দ্রুত।
গার্ডিয়ান জানিয়েছে, সুইডেনের কুলাবার্গ অভয়ারণ্যে প্রজাপতি ও মথের ক্ষেত্রে বড় মাত্রার বিলুপ্তির ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। ৫০ বছর আগে থাকা ৬০০ প্রজাতির মধ্যে এক তৃতীয়াংশ প্রজাতিই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হারিয়েছে প্রজাপতি। ইংল্যান্ডে ৩৪০ প্রজাতির মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ প্রজাতির প্রজাপতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে, ১৯৬৮ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে।
যুক্তরাষ্ট্রে ১৯০০ সাল থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে চার প্রজাতির ভ্রমর হারিয়ে গেছে। আট প্রজাতির ভ্রমরের সংখ্যা দিন দিন কমছে। বিজ্ঞানীরা এর জন্য মানুষের কৃষিকাজ ও তাতে কীটনাশক ব্যবহারকে দায়ি করেছেন।
১৯৯০-এর দশক থেকে জাপানে লাল রঙের ফড়িংয়ের সংখ্যা হু হু করে কমছে। এর জন্য দায়ি ধান চাষে ব্যবহৃত কীটনাশক। পতঙ্গটি বংশবিস্তার করতে না পেরে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ও নেভাডাতে ফড়িংয়ের সংখ্যা ১৯১৪ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী একশ বছরে ৬৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
ইউরোপে তৃণভূমিগুলোতে থাকা কীটপতঙ্গের একটি বড় অংশ জুড়েই রয়েছে পাতা ফড়িং ও গাছ ফড়িং। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, জার্মানিতে ২০১০ সাল পর্যন্ত গত ৫০ বছরে এদের সংখ্যা ৬৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে মাটির অম্লতা বেড়ে গেছে সেখানে। আর এতেই ঘটেছে এই হ্রাস।
১৯৯৪ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চলা গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যে ৬৮ প্রজাতির গুবরে পোকার মধ্যে এক তৃতীয়াংশই দ্রুত গতিতে হ্রাস পাচ্ছে। দেশটিতে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির গুবরে পোকার প্রতি ছয়টি প্রজাতির মধ্যে একটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ৬০ লাখ মৌচাক ছিল। কিন্তু এর মধ্যে ৩৫ লাখই এখন আর নেই।
//এআরএইচ//
Comments are closed.